খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ পৌষ, ১৪৩১ | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫
  গাজীপুরের শ্রীপুরে বোতাম তৈরির কারখানায় আগুনে নিহত ১

ধানমন্ডিতে দু’টি দুর্ধর্ষ ডাকাতি

এ এম কামরুল ইসলাম

ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোডে অবসরপ্রাপ্ত চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্টের বাসায় দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হলো। ডাকাতদল দোতলা বাড়ির নিচতলার জানালার গ্রীল কেটে ঘরে প্রবেশ করে চীফ কনজারভেটর মহোদয়কে মারধরপূর্বক মারাত্মক আহত করলো। তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে আলমারির চাবি নিয়ে মূল্যবান সোনা-দানা, টাকা-পয়সা, একটি দোনালা বন্দুক, একটি টু টু বোর রাইফেল নিয়ে গেল। রাতের ডিউটিরত অফিসার থানার গাড়িতে করে আহত বাড়িওয়ালাকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীর শরীরের আঘাত তেমন গুরুতর না হলেও তিনিও একই সাথে একই হাসপাতালে ভর্তি হলেন।

ধানমন্ডি থানায় ওসি হিসেবে তখন সদ্য যোগদান করেছিলেন জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব। ভোর বেলায় ওসি ধানমন্ডি, এসি রমনা জোন, ডিসি সাউথ, ডিসি ডিবি সকলেই ডাকাতির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছিলেন এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সকলেই অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কারণ চীফ কনজারভেটর সাহেবের স্ত্রী ছিলেন ভীষণ রগচটা মহিলা ও মহা ক্ষমতাধর। পরবর্তীতে শুনেছিলাম, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব আজিম উদ্দিন সাহেব ছিলেন তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ। জনাব আজিম উদ্দিন সাহেবের সাথে তৎকালীন মহামান্য রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এসব কাহিনী পুলিশের উপর মহলে সবার জানা ছিল। তাই, মহিলার সকল ঝাড়ি, সকল অফিসার অকাতরে হজম করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

যাহোক, উর্ধতন মহল সকল দিকে সামাল দিতে প্রথমেই ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকায় ঐ রাতে ডিউটিতে থাকা তিনজন কনস্টেবলকে সাময়িক বরখাস্ত করার আদেশ দিলেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। একটু পরেই সদ্য যোগদানকৃত ওসি সাহেবকে ধানমন্ডি থানা থেকে ক্লোজ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হলো। উর্ধতন মহলের আদেশে থানার দায়িত্বভার আমার উপর অর্পিত হলো এবং ডিসি সাউথ জনাব আমিনুল ইসলাম সাহেব নিজেই থানায় দীর্ঘ সময় অবস্থান করলেন। তিনি আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আমার সারদায় ট্রেনিং এর সময় তিনি ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল। তিনি থানায় দুপুরের খাবার খেয়ে প্রায় এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেললেন। ওসি সাহেবের পুলিশ লাইনে ক্লোজের আদেশ পেয়ে তিনি নিজেও আতংকে ছিলেন।

এক পর্যায়ে বিকাল বেলায় তিনি আমাকে একাকী ডেকে নিয়ে বললেন, ‘কামরুল, এই ডাকাতির ঘটনায় এ পর্যন্ত যা-কিছু হয়েছে তার সবই তুমি জানো। এরপর কার কী হবে তা জানিনা। তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তাই তোমাকে একই সাথে ওসির দায়িত্ব এবং এই ডাকাতি মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো। তুমি থানা ঠিকমতো দেখাশোনা কর, আর ডাকাতি মামলার যা ইচ্ছে তাই কর। শুধু, ঐ ভদ্র মহিলাকে যেভাবে পারো সামাল দাও। আর যেন কোন অফিসার ভিকটিমাইজ না হয়’।

একটু পর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ডিসি সাহেব তাঁর অফিসে রওনা হলেন। আমিও থানার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গাড়িতে করে ১৫ নম্বর রোডে সংঘটিত সেই ডাকাতি মামলার ঘটনাস্থল দেখতে রওনা হলাম।

বাড়ির গেটে গিয়ে দেখলাম সেখানে দুইজন কনস্টেবল রাইফেল হাতে ডিউটি করছেন। তারা অত্যন্ত ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। আমাকে দেখে তারা সামান্য আশ্বস্ত হলেন। আমি তাদের কাছে বাড়ির ভিতরের হালচাল জানতে চেষ্টা করলাম। তারা বললেন, ‘স্যার, আমরা কেউ বাড়ির ভিতরে যেতে সাহস করিনি। তবে একটু আগে বাড়ির ম্যাডাম হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন । তাঁর গাড়ি ভিতরে ঢুকার সময় তিনি গাড়ির জানালা খুলে আমাদের ঠিকমত ডিউটি করতে বলে গেলেন’।

আমার গাড়ি বাড়ির বাইরে রেখে অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। বাড়ির বারান্দায় একজন সুদর্শন ছেলে দেখে তার কাছ থেকে হালচাল বুঝতে চেষ্টা করলাম।

ছেলেটি বললো- তার নাম বাবুল। সে ঐ বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকে। মূলতঃ তিনি একজন ফরেস্ট গার্ড। চীফ কনজারভেটর হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পরও ঐ ফরেস্ট গার্ডকে তিনি বাসায় রেখে দিয়েছিলেন। কারণ, তাঁদের একমাত্র ছেলে লন্ডনে এমবিএ পড়াকালীন হঠাৎ সেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর একমাত্র বাবুলের হাতে ছাড়া আর কারো হাতে সে কোনকিছু খেতো না। এমনকি তার মায়ের হাতেরও কোন খাবার খেতো না।

বাবুল বললেন, ‘স্যার, বেগম সাহেব একটু আগে হাসপাতাল থেকে ফিরে খাবার খাচ্ছেন। আমি ভাইয়াকে খাওয়াচ্ছি। আপনি একটু বসেন। বেগম সাহেবকে আপনার কথা বলছি’।

আমি সুযোগ বুঝে বাবুলের সাথে ঘরে ঢুকলাম। বাবুল পক্ষাঘাতগ্রস্ত সেই ছেলেটিকে চামচ দিয়ে খাওয়াতে লাগলো। অসাধারণ সুন্দর চেহারা অথচ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ফুটফুটে ছেলেটিকে দেখে আমার ভীষণ মায়া হলো। আমি তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাবুল বললেন- ‘স্যার, ভাইয়া সবকিছু বুঝতে পারেন, কিন্তু কোন কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারেন না। তিনি শুধু আমার হাতে খাবার খান’।

আরো কিছু সময় ছেলেটিকে দেখলাম। সেও আমাকে দেখলো। এক পর্যায়ে বাবুলের হাত থেকে খাবারের চামচ নিয়ে আমি তার মুখে দিলাম। সে অনায়াসে আমার হাত থেকে খেতে শুরু করলো। এমন সময় তার মা ঐ ঘরে প্রবেশ করলেন। আমার হাত থেকে তাঁর ছেলেকে খেতে দেখে একটু বিস্মিত হয়ে বাবুলকে জিজ্ঞেস করলেন-
‘বাবুল এই ছেলে কে’?

আমি ঢোক গিলতে গিলতে বললাম- ম্যাডাম আমার নাম কামরুল। আমি ধানমন্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার। ওসি সাহেব সাসপেন্ড হয়ে গেছে। তাই আমাকে ওসির দায়িত্ব দিয়েছে। আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?

-আমি ভাল আছি। কিন্তু সাহেব এখনও হাসপাতালে। আমি তাঁর জন্য খাবার নিয়ে যাবো।

-ম্যাডাম, আপনি অনুমতি দিলে আমি স্যারকে দেখতে হাসপাতালে যাবো। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যারা এই ডাকাতি করেছে তাদের আমি ধরে উপযুক্ত শাস্তি দেবো এবং আপনার মালামাল উদ্ধার করে ফেরত দেবো।

তিনি আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি পুলিশের লোকজন চিনি। তারা কোন কাজ ঠিকমতো করে না। গতকাল রাতে যারা এই এলাকায় ডিউটিতে ছিল তারা ঠিকমতো ডিউটি করলে ডাকাতি হতো না। আমরা এত চেচামেচি করলাম কিন্তু তারা কেউ এলো না। পাশের বাড়ির লোকজনও কোন সাহায্য করলো না। তুমি দেখতো পাশের বাড়িটি কার। তারা কেন সাহায্য করতে এলো না’।

আমি একটু সাহস সঞ্চার করে বললাম- ম্যাডাম, কাল রাতে যারা ডিউটিতে ছিল তারা সাসপেন্ড হয়ে গেছে। ওদের চাকরি থাকবে না। পাশের বাড়ির লোকদের খবর নিয়ে তাদেরকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো। আগে চলেন, হাসপাতালে স্যারকে দেখে আসি।

তিনি আমার কথাবার্তা কিভাবে নিলেন তা বুঝে ওঠবার আগে তিনি বললেন- ‘তুমি খাবার খেয়েছো’?

-হাসপাতাল থেকে স্যারকে দেখে তারপর খাবো।
তিনি বললেন- ‘আমার সাথে এসো’।

আমি কোন কথা না বলে তাঁর পিছু পিছু গেলাম। তিনি ডাইনিং টেবিলে নিয়ে আমাকে খেতে হুকুম দিলেন। আমি কোন আপত্তি না করেই খেতে বসলাম। আমার খাওয়ার মধ্যে তাঁর ফোন বেজে উঠলো। তিনি ফোনে তাঁর স্বামীর অবস্থা জানানোর পর বললেন- ‘শোন আজিম, ধানমন্ডি থানার ওসিকে সাসপেন্ড করে ভাল করেছো। এখন কামরুল ওসি হয়েছে। তাকে এই থানায় রেখে দিও’।

তাঁর কথা শুনে আমার গলা দিয়ে খাবার নিচে নামছিল না। টেলিফোনে ম্যাডাম যাকে ‘আজিম’ বলে, ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করলেন তিনিই যে মাননীয় স্বরাষ্ট্র সচিব তা বুঝতে আমার বাকি রইলো না।

কোনমতে খাবার খেয়ে ম্যাডামের সাথে আমি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে গেলাম। সেখানে গিয়ে চীফ কনজারভেটর সাহেবের সাথে কথা বলে ডাকাতদের বর্ণনা জানতে চেষ্টা করলাম এবং তাঁকে সান্ত্বনা দিলাম। একাধারে থানার ওসির দায়িত্ব এবং ঐ ঝামেলাপূর্ণ ডাকাতি মামলার বোঝা নিয়ে আমার খাওয়া ঘুম বন্ধ হয়ে গেল।

আমি ধানমন্ডি থানায় প্রথম যোগদানের কিছুদিন পর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় একজন সচিবের বাড়িতে রাতের বেলা ডাকাত ঢুকে গ্রিল কাটার সময় বাড়ির লোকজন টের পেয়ে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেছিলেন। ঐ রাতে আমি টহল ডিউটিতে ছিলাম। কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়ারলেস মারফত মেসেজ পেয়ে বাড়ি ঘেরাও করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দু’জন ডাকাতকে আমি পাকড়াও করেছিলাম। বাড়িটি ছিল প্রাচীর বেষ্টিত। প্রাচীরের মধ্যে বাগানের ভিতর দু’জন ডাকাত লুকিয়ে ছিল। তাদের গ্রেপ্তার করার পর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে জেনেছিলাম তারা শুধুমাত্র ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ডাকাতি করতো। একজনের নাম ছিল মোস্তফা ও অন্য জনের নাম করিম। তাদের দু’জনের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলায়। ডাকাত মোস্তফা অপরাধ জগতে বদ্দা মোস্তফা হিসেবে পরিচিত ছিল। ডাকাতির কাজে সে একটি নিজস্ব মাইক্রোবাস ব্যবহার করতো। তাকে গ্রেপ্তারের পর জেলে প্রেরণ করেছিলাম।

বর্তমান মামলার ধরণ দেখে আমার সন্দেহ হলো মোস্তফা গ্যাং এই ডাকাতির সাথে হয়তো জড়িত। মোস্তফাকে আগেই জেলে পাঠান হয়েছিল বিধায় তার দলের লোকদের খোঁজ খবর নিতে থাকলাম। অন্যদিকে মোস্তফা জামিন পেয়েছে কিনা তা জানার জন্য এস আই শহীদ সাহেবকে কোর্টে খবর নিতে পাঠালাম। কিন্তু এস আই শহীদ সাহেব সঠিক খবর না নিয়ে এসে জানালেন -মোস্তফা জেলেই আছে। তবে আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হলো না।

তিনদিন পার হয়ে গেল। প্রতিদিন কয়েকবার আমি চীফ কনজারভেটর সাহেবের বাসায় ও হাসপাতালে যোগাযোগ রাখতাম এবং সকল আপডেট ডিসি সাহেবকে অবগত করতাম। সেই মহা ক্ষমতাধর ম্যাডাম ইতোমধ্যে আমার খালা আম্মায় রুপ নিলেন। এক পর্যায়ে তিনি প্রতি ওয়াক্তে খাবার আগে আমাকে ফোন করে তাঁর সাথে খেতে ডাকতেন। এসব শুনে ডিসি সাহেব আমার উপর ভীষণ খুশী হতেন।

কয়েকদিন যেতে না যেতেই ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় আবার এক বাড়িতে একই কায়দায় ডাকাতি হয়ে গেল। তাও আবার ছোটখাটো বাড়িতে নয়। খোদ জনাব হুমায়ুন খান পন্নি সাহেবের বাড়িতে। টাংগাইলের বিখ্যাত পন্নি পরিবারের নাম সবার জানা। জনাব হুমায়ুন খান পন্নি পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পীকার হয়েছিলেন।

ভাবলাম এবার আমার সাসপেন্ড হওয়ার পালা। সৌভাগ্যক্রমে জনাব হুমায়ুন খান পন্নি সাহেব তখন দেশে ছিলেন না। ঐ বাড়ির জার্মান প্রবাসী মেয়ে ও জার্মানি জামাই ঐ রাতে বাসায় ছিলেন। তাঁদের মূল্যবান কিছু মণিমুক্তাখচিত গয়নাপত্র ও সামান্য টাকা পয়সা ডাকাতি হলেও তাদের মার্জিত ব্যবহারে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। আমি নতুন ওসির দায়িত্বে থাকায় ডিসি সাহেব নিজে থানায় এসে সবকিছু সামাল দিলেন। ঘটনাটি ডাকাতি হলেও ডাকাতের সংখ্যা চারজন দেখিয়ে দস্যুতা মামলা রেকর্ড করে এস আই শাহ আলম সাহেবকে তদন্তভার দিলাম। সবকিছু মিলে ‘মরার উপর খড়ার ঘা’ নিয়ে সময় গুনতে থাকলাম- কবে নতুন ওসি এসে আমাকে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি দিবেন।

পরদিন বিকালে মিরপুর স্টেডিয়ামে আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ফাইনাল খেলা ছিল। সেখানে আমার ডিউটি থাকায় এক প্লাটুন ফোর্সের ইনচার্জ হয়ে খেলার ডিউটি করছিলাম। এমন সময় থানা থেকে এস আই আতিয়ার রহমান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে হাজির হলেন। আমার হাতে একটা ষ্টার সিগারেটের ছেঁড়া খালি প্যাকেট দিয়ে বললেন- ‘এই সিগারেটের ছেঁড়া খালি প্যাকেটটি পন্নি সাহেবের বাড়িতে পাওয়া গেছে। আমি কাউকে না দেখিয়ে আপনার কাছে সরাসরি নিয়ে এসেছি। এতে কী লেখা আছে একটু পড়ে দেখেন’।

আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখলাম। তাতে লেখা ছিল – ‘এই ডাকাতি করেছে উজ্জ্বল। তার বাবার নাম চুন্নু মিয়া। গ্রাম কামার খোলা, থানা শ্রীনগর, জেলা মুন্সিগঞ্জ’।

খেলার ডিউটি শেষে থানায় ফিরে আমি ডিসি সাহেবের কাছে চিরকুটের কথা খুলে বলে রাতে শ্রীনগর যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি বললেন- ‘এই মামলার বিষয়ে তুমি শ্রীনগর কেন, শ্রীলঙ্কা যাবার দরকার হলেও যাবে। কারো অনুমতি লাগবে না’।

রাত অনুমান দশটার দিকে একটি জীপে করে এস আই শাহ আলম সাহেব ও দুইজন কনস্টেবল নিয়ে শ্রীনগর রওনা হলাম। গাড়িটি সরবরাহ করেছিলেন প্রথম ডাকাতির ঘটনার শিকার চীফ কনজারভেটর মহোদয়ের শ্যালক।

গভীর রাতে শ্রীনগর থানায় পৌঁছে ওসি সাহেবকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তাঁর সহায়তা কামনা করলে তিনি রাতের বেলা কামারখোলা গ্রামে যেতে নিষেধ করে ফোর্স দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। কারণ ঐ গ্রামে রাতের বেলা যাওয়া তিনি নিরাপদ মনে করলেন না। আমাদের কোন আবেদন নিবেদনে তাঁকে টলানো গেল না। শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র রাস্তা চিনানোর জন্য একজন চৌকিদার সাথে দিলেন। আমরা সকল ঝুঁকি নিজেদের মাথায় নিয়ে কামারখোলা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর চৌকিদার বললেন- ‘এখন বিলের ভিতর দিয়ে পানি পার হয়ে বেশ কিছু পথ পাড়ি দিতে হবে’।

কোথাও হাটু পানি, কোথাও কোমর পানি ভেঙে কামারখোলা গ্রামে চুন্নু মিয়ার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। চুন্নু মিয়ার বয়স তখন প্রায় ষাট বছর। তার দুই চোখ অন্ধ।

চৌকিদার আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন- ‘চুন্নু মিয়া এই এলাকায় ‘চুন্নু চোরা’ বলে পরিচিত। অনেক বছর আগে তার চুরির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে এলকার লোকজন তার দুটো চোখ খেজুরের কাঁটা দিয়ে তুলে দিয়েছিল। তার দুই স্ত্রী আছে। চুরি করে ঢাকা শহরের স্বামীবাগে সে একটা বাড়ি করেছে। তার ছোট স্ত্রী সেই বাড়িতে থাকে।

চুন্নু মিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানালো- উজ্জ্বল তার ছেলে। সে ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকে।

আমরা তার কথা বিশ্বাস করলাম এবং সেই বাসা কে চিনে তা জানতে চাইলাম। সে বললো- ‘ওর মা চিনে’।

সুতরাং সময় নষ্ট না করে ঐ মহিলাকে সাথে নিয়ে রাতের মধ্যে কেরানীগঞ্জ যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আইন অনুযায়ী আমাদের আবার শ্রীনগর থানায় গিয়ে রিপোর্ট করার কথা। কিন্তু সময় অভাবে আমরা তা না করে সরাসরি কেরানীগঞ্জ থানার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।

রাতারাতি কেরানীগঞ্জ থানায় পৌঁছে ওসি সাহেবকে না পেয়ে সেকেন্ড অফিসারকে ঘুম থেকে উঠালাম। সেকেন্ড অফিসার ছিলেন আমার ব্যাচমেট জনাব নিলুৎপল দে। তিনিও উজ্জ্বলের বাসার এলাকায় কম ফোর্স নিয়ে মুভ করতে নিরুৎসাহিত করলেন। কিন্তু কোন ভয়ে ভীত না হয়ে উজ্জ্বলের মাকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে তার বাসা খুঁজাখুঁজি করে কোন লাভ হলো না। তার মা বললো-
সে মাত্র দুইবার ঐ বাসায় গিয়েছে। কিন্তু রাতের আঁধারে ঠিক বাসার লোকেশন বের করতে পারছে না। হয়তো ওটা তার চালাকি ছিল, অথবা প্রকৃতই চিনতে পারছিল না।

আমরা তাকে বললাম- আপনার বাড়ির আর কে ঐ বাসা চিনে?

তিনি বললেন, তার জামাই চিনে।
-সে কোথায়?
-সে বাড়িতে আছে।

আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আবার সেই বিল পাড়ি দিয়ে শ্রীনগর যেতে হবে!

কোন কষ্ট আমাদের গতি রোধ করতে পারলো না। চাকরির ভয়ে এবং ডাকাতি মামলার রহস্য উদঘাটনে মরিয়া হয়ে আমরা কাজ করছিলাম। এস আই শাহ আলম সাহেবও বেশ কর্মঠ অফিসার ছিলেন। আমি তাকে পুনরায় শ্রীনগর যেতে বললে তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে উজ্জ্বলের মাকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। আমি কেরানীগঞ্জ এলাকায় থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম।

এস আই শাহ আলম সাহেব শ্রীনগর থেকে উজ্জ্বলের ভগ্নিপতিকে সাথে নিয়ে ভোর নাগাদ আবার কেরানীগঞ্জ পৌঁছে গেলেন। তাকে নিয়ে অতি সতর্কতার সাথে উজ্জ্বলের বাসায় পৌঁছে এক প্রকার অতর্কিতে তার ঘরে ঢুকে দেখলাম শুধু একজন মহিলা ঘরে আছে। তার কাছে উজ্জ্বলের কথা জানতে চাইলে সে বললো-

‘উজ্জ্বল আমার স্বামী। সে রাতে বাসায় আসেনি।

তার ভাবগতিক দেখে মনে হলো, সে কিছু গোপন করছে।

আমি তখন আমার পকেট থেকে সেই চিরকুট লেখা সিগারেটের ছেঁড়া প্যাকেটটি বের করে দেখাতেই সে বললো- ‘এই হাতের লেখা আমি চিনছি। এইডা আমার আগের স্বামী মুজিবের হাতের লেখা। সে চুরি করে বার বার জেলে যাওয়ায় তাকে ছাইড়া আমি উজ্জ্বলকে বিয়ে করছি। উজ্জ্বল মজিবরের আপন ছোট ভাই। মজিবর কয়দিন আগে জেল থাইকা ছাড়া পাইছে। সে উজ্জ্বলকে ফাঁসানের জন্যি এই কাম করেছে’।

মহিলার কথার দৃঢ়তা দেখে কিছুটা বিশ্বাস হলো। তবে ঘরের বিছানাপত্র দেখে মনে হলো তার স্বামী আশেপাশেই আছে। তাই মহিলাকে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না দিয়ে আমরা গোপনে আশেপাশে অবস্থান নিলাম। উজ্জ্বলের দৈহিক বর্ণনা আমারা আগেই জেনে নিয়েছিলাম।

ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর আমাদের টার্গেটের সাথে মিলে যাওয়া একটি যুবককে মেছওয়াক হাতে আসতে দেখে তাকে পাকড়াও করে বললাম – তোমার নাম উজ্জ্বল?

সে বললো -হ্যাঁ।

আমরা তাকে তার বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে সে বললো- আমি এহানে বেড়াতি আইছি। আমার বাড়ি শ্রীনগর।

আমরা তার চালাকি বুঝতে পারলাম। সাথে সাথে হাতকড়া পরিয়ে তার দেহ তল্লাশি করে কোমরে একটা বড় চাকু পেয়ে আমাদের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো।

কোমরে চাকু রাখার কারণ জানতে চাইলে উজ্জ্বল বললো- ‘স্যার, আমারে মাইরেন না। আমি সব সত্যি বলবো। আমি আমার আপন ভাবিরে বিয়ে করছি। তাই আমার ভাই যেকোন সময় আমারে মারতি পারে। তাই সব সময় আমি চাকু সাথে রাহি। আমার বাসা পাশেই আছে। চলেন আমি আপনাগে আমার বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। আসলে প্রথমে ভয় পায়ে মিথ্যে কথা কইছিলাম’।

উজ্জ্বলকে নিয়ে আমরা আবার তার বাসায় গিয়ে সারা ঘরে তল্লাশি করলাম। কিন্তু সন্দেহজনক তেমন কিছু পাওয়া গেল না।

উজ্জ্বলের স্ত্রী বললো- ‘স্যার, আপনারা তারে নিয়ে গেলি মজিবর আমারে মারে ফেলাবে। তার চাইতে মজিবর জেল থাইকা ছাড়া পায়ে যেহানে থাহে সেই জাগা আমি চিনি। আপনারা আমারে সাথে নিয়ে চলেন। আমি তারে ধরায়ে দিবানি। সে ডেমরা থানার এক বস্তির মদ্দি তার দূর সম্পর্কের বোন কুলসুমের কাছে থাহে’।

আমরা তাদের ঘরে তালা দিয়ে পাশের বাড়ির লোকজনকে দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়ে দু’জনকে নিয়ে ধানমন্ডি থানার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। থানায় গিয়ে দেখি নতুন ওসি জনাব আব্দুল মতিন সাহেব যোগদান করেছেন। আমি তাঁকে থানার দায়িত্ব বুঝে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম এবং ডাকাতির ঘটনা উদঘাটনে বেশি মনোযোগ দিলাম।

সারারাত জেগে অমানসিক পরিশ্রম করেও ডাকাত ধরার নেশায় উজ্জ্বলকে থানায় আটক রেখে তার স্ত্রীকে নিয়ে ডেমরা এলাকার সেই বস্তিতে গিয়ে হাজির হলাম। উজ্জ্বলের স্ত্রীর দেখানো মতে কুলসুমের বাসায় গিয়ে কুলসুমকে পেয়ে তার কাছে মজিবরের কথা জানতে চাইলে সে আকাশ থেকে পড়লো এবং উজ্জ্বলের স্ত্রীর সাথে তুমুল ঝগড়াঝাটি করতে চেষ্টা করলো। সে আরো জানালো মজিবর অনেক আগে থেকেই জেলে আছে। কিন্তু উজ্জ্বলের স্ত্রী নিশ্চিত করে বললো সে এখানেই আছে।

তাদের উভয়কে নিবৃত্ত করে আমরা ঘর তল্লাশি করে বেশ কিছু সন্দেহজনক জিনিস পেলাম। একটা আলমারির উপরে একটি লন্ড্রির স্লিপ পেলাম। তাতে মজিবরের নামে অনেক কাপড় ধোলাইয়ের তালিকা পেলাম। ঐ স্লিপ দেখে আমি নিশ্চিত হলাম মজিবর ওখানেই ছিল। তখন আমি একটু কৌশল খাটিয়ে উজ্জ্বলের স্ত্রীকে ধমক দিয়ে কুলসুমের পক্ষ নিলাম। তাতে কুলসুম বেশ খুশি হলো। উজ্জ্বলের স্ত্রীকে হাতকড়া লাগিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে কুলসুমকে আরো আশ্বস্ত করলাম। মজিবরের অবস্থান আরো নিশ্চিত হতে লন্ড্রির স্লিপ নিয়ে পুরো টাকা দিয়ে তার ধোলাই করতে দেওয়া কাপড় নিয়ে এলাম। মজিবর এই এলাকাতেই আছে তা আমি নিশ্চিত হলাম। ডাকাতির টাকা হাতে পেয়ে মজিবর পুরাতন লুঙ্গিও লন্ড্রিতে দিয়ে ধোলাই করাতো।

কুলসুমকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আমরা ধানমন্ডি থানায় ফিরে যাওয়ার আগে আমার একজন বিশ্বস্ত সোর্সকে সেখানে রেখে আসলাম। তাকে যথাযথ আদেশ উপদেশসহ কিছু হাতখরচ দিয়ে বললাম- মইজাকে এই এলাকায় দেখামাত্র থানায় ফোন করে আমাকে জানাবে। সে মজিবরকে আগে থেকেই চিনতো। সে আমাকে আগেই জানিয়েছিল, মজিবর ওরফে মইজা বড় বড় চুরি ডাকাতি করে এবং কিছু কিছু অসাধু পুলিশের সাথে তার খাতির আছে। তাকে ধরে বেশিদিন আটকানো যায় না।

আমরা ঐ জায়গা থেকে চলে যাবার পর মইজা ঠিকই কুলসুমের বাসায় গেল। আমার নিযুক্ত সোর্স তাকে কৌশলে আটক করে পার্শ্ববর্তী ডেমরা থানায় নিয়ে গেল। মইজা ডেমরা থানার ডিউটি অফিসারকে কব্জা করে নিজে আটক হওয়ার পরিবর্তে আমার নিযুক্ত সোর্সকেই মিথ্যা দোষ চাপিয়ে আটক করার ব্যবস্থা করলো। আমার সোর্স কোনমতে ডেমরা থানার ডিউটি অফিসারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ধানমন্ডি থানায় ফোন করে হাফাতে হাফাতে বললো- ‘তাড়াতাড়ি আসেন স্যার। মইজাকে আটক করে আমি বিপদে পড়িছি। মইজাকে ছাইড়া আমারে আটকাচ্ছে’।

আমি ফোন রেখেই একটি বেবীট্যাক্সী নিয়ে ডেমরা থানায় হাজির হলাম। ডিউটি অফিসার আমার সোর্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললেন- ‘এই লোকটি আপনার নাম বিক্রি করে অহেতুক একটা নিরীহ লোককে ধরে থানায় এনেছে’।

মইজা নিজেও অত্যন্ত গাম্ভীর্যের সাথে আমার সোর্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। আমি সবকিছু অনুধাবন করে পকেট থেকে সেই চিরকুট লেখা সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার সামনে বের করা মাত্রই সে নরম হয়ে গেল। ডিউটি অফিসারকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মইজাকে নিয়ে ধানমন্ডি থানায় চলে গেলাম। মইজা তার ভাই উজ্জ্বল ও সাবেক স্ত্রীকে থানায় দেখে বললো-

‘স্যার, দয়া করে আমারে মারবেন না। আমি সব সত্যি কথা কবো’।

মইজা এক এক করে সব কথা বলতে শুরু করলো।

সে বললো- ‘আমি দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম। কয়েকমাস আগে চিটাগং এর বদ্দা মোস্তফা ও করিম নামে দুইজন লোক ধানমন্ডি থানায় ধরা খেয়ে জেলে যায়। জেলখানায় আমরা একই রুমে ছিলাম। জেলে থাকা অবস্থায় আমি বদ্দা মোস্তফাকে বাবা ডাকি। সে আমাকে জামিন করার ব্যবস্থা করায়। তার অনেক টাকা ও ভাল লাইন আছে। আমরা তিনজন একসাথে জামিন পাওয়ার পর আমি বাড়ি গিয়ে দেহি আমার বউ উজ্জ্বলের সাথে চলে গেছে। আমি মনের দুঃখে বদ্দা মোস্তফার বাসায় আশ্রয় নি। তার বাসা খিলগাঁ থানার রেলগেট এলাকায়। সেহানে তার ছোট বউকে নিয়ে থাহে। তারপর থেইকা আমরা একসাথে কাজ করি। বদ্দা মোস্তফার একটা মাইক্রোবাস আছে। প্রতি রাতে ঐ মাইক্রো নিয়ে আমরা ধানমন্ডি এলাকায় কাজ করি। বদ্দা মোস্তফা ধানমন্ডি ছাড়া অন্য এলাকায় কাজ করতি রাজি হয় না। কয়েকদিন আগে ধানমন্ডি এলাকায় দুটো বড় বড় কাজ হইছে। সব টাকা পয়সা ও মালামাল বদ্দা মোস্তফার কাছে আছে। আমারে কিছু হাত খরচ দিছিল। তাই দিয়ে কোনমতে চলছি’।

তখন ছিল রমজান মাস। বিকাল হয়ে যাওয়ায় আমরা সকলেই অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। সময়ক্ষেপণ করলে পরবর্তী টার্গেট হাতছাড়া হতে পারে বিধায় আমরা সাদা পোশাকে একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে মইজাকে হাতকড়া পরিয়ে বদ্দা মোস্তফার বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম।

মোস্তফার বাসার কাছে গিয়ে একটু দূর থেকে চলন্ত বেবীট্যাক্সী থেকে মইজা বাসা চিনিয়ে দিল। কিন্তু মোস্তফা বাসায় আছে কিনা তা নিশ্চিত না হয়ে আমরা বাসায় প্রবেশ করলাম না। বরং, সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার চোখে পড়লো বদ্দা মোস্তফা মেছওয়াক করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। আমি আগেও মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করেছিলাম। তার মুখে সুন্দর দাঁড়ি ছিল। তাই তাকে চিনতে আমার একটুও ভুল হলো না। আমার বেবীট্যাক্সীতে থাকা মইজাও মোস্তফাকে দেখে ইশারায় দেখিয়ে দিলো।

আমি বেবীট্যাক্সী থেকে নেমে মোস্তফার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে দিলাম। মোস্তফাও আমাকে চিনে বললো- ‘স্যার, আপনি এখনও আমার পিছনে লাইগা আছেন? আমি তো ভাল হয়ে গিছি। দেখেন আমি সবগুলো রোজা আছি’।

আমি বললাম- তোর বাসা কোথায়?

-আমি এহন চিটাগং আমার গ্রামের বাড়িতে থাহি। এহানে বেড়াতি আইছি।

আমি বললাম- চল তোকে তোর বাসায় নিয়ে যাই।

মোস্তফাকে নিয়ে বেবীট্যাক্সীতে ওঠার পর মইজাকে দেখে সে অবাক হলো। তার কোনকিছু বুঝতে বাকি রইলো না। তাকে নিয়ে তার বাসার দরজায় নক করতেই ভিতর থেকে একজন শিক্ষিতা সুন্দরী মহিলা দরজা খুলে দিলেন। তার বাসার সাজসজ্জা দেখে রীতিমতো বিস্মিত হলাম। তার স্ত্রীর চেহারা ছিল চোখে পড়ার মতো। সমস্ত শরীরে সোনা গয়নায় ভরা ছিল। তার বাসা তল্লাশি করে প্রচুর সোনা গয়না, টাকা পয়সা ও মূল্যবান জিনিস পত্র পাওয়া গেল। কিন্তু মোস্তফা নিজেকে সাধু হিসেবে প্রমাণ করতে চেষ্টা করলো। শুধুমাত্র, ধানমন্ডি থানার দুটো ডাকাতির ঘটনায় লুণ্ঠিত কোন মালামাল তার বাসায় পাওয়া গেল না।

আমরা থানার ওসি সাহেবকে ফোন করার চেষ্টা করেও আশেপাশে কোন টেলিফোন পাওয়া গেল না। তাই ওয়ারলেসের মাধ্যমে ওসি সাহেবকে সব ঘটনা জানালে ওসি সাহেব সাথে সাথে আমাদের উদ্দেশ্যে রওনা করলেন। আমাদের ওয়ারলেস কথোপকথন পুরোটাই ডিসি সাহেব ওভার হেয়ার করে তিনি ওয়ারলেসে বললেন,
‘কামরুল, তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তোমার ওখানে আসছি। আমার আসতে ইফতারের সময় হয়ে যাবে। আশেপাশে কোথাও ইফতারের ব্যবস্থা রেখো’।

আমরা মোস্তফার বাসা থেকে সন্দিগ্ধ মালামাল জব্দ করে ওসি ও ডিসি সাহেবকে নিয়ে একটি হোটেলে ইফতার করলাম। তারপর আসামিদের নিয়ে থানায় রওনা হলাম।

থানায় গিয়ে মোস্তফা এমন ভাব নিলো, যেন সে ধোয়া তুলশী পাতা। তাকে অহেতুক অপমান করায় পারলে মইজাকে মারতে চায়। আমরাও রীতিমতো দোটানায় পড়ে গেলাম। তাকে মোটামুটি পিটুনি দিলেও সে আরো কঠিনভাবে দৃঢ়তা প্রকাশ করতে থাকলো। তখন উল্টো মইজাকে পিটানো শুরু করলাম।

এক পর্যায়ে মইজা গোপনে বললো- ‘স্যার, মোস্তফাকে হাজার পিটালেও সে কখনও সত্যি কথা কবে না। তার মুখে গামছা বান্দে পানি ঢাললে হড়হড় করে সব কয়ে দেবে। সে পানি ঢালাকে ভীষণ ভয় পায়’।

মইজার কথা মতো এক বালতি পানি ও একটা গামছা আনার সাথে সাথে মোস্তফা বললো- ‘স্যার, আমারে নিয়ে চলেন। সব মালামাল আমি দিয়ে দিচ্ছি’।

তার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হওয়ায় তাকে নিয়ে ওসি সাহেবের গাড়িতে করে রওনা হলাম। সে আমাদের ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে নিয়ে গেল। ঐ বাড়িটিও ছিল দেড় বিঘার প্লট। বাড়ির ভিতরে প্রচুর গাছ ছিল। সেই গাছের আড়ালে নারকেল পাতার নিচে পনের নম্বর রোডের চীফ কনজারভেটর সাহেবের লুন্ঠিত বন্দুক, টু টু বোর রাইফেল ও হুমায়ুন খান পন্নি সাহেবের বাড়ির লুন্ঠিত মণিমুক্তা পাওয়া গেল। ঐ বাড়ির লোকজন এসব মালামাল তাদের বাগানে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। আমরা সেখান থেকে মালামাল জব্দ করে আরো বেশি উদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকলাম।

কিন্তু মোস্তফা বললো- ‘স্যার এবার জেল থেইকা বের হয়ে মাত্র এই দুটো কাম করিছি। বিশ্বাস না হয় চলেন, আমার গ্রীল কাটার যন্ত্র এই এলাকায় এক জাগায় পুতা আছে। আমি ধানমন্ডি এলাকা ছাড়া কোথাও কাজ করি না। তাই আমার জিনিসপত্র এই এলাকায় রাইখা যাই। তাছাড়া রাত-বিরাতে মাইক্রো নিয়ে চলার সময় মাঝে মাঝে পুলিশ চেক করে। তাই সন্দেহজনক জিনিস গাড়িতে না রাখে জায়গামতো রাখে যাই। কাজের সময় আবার সেখান থেইকা নিয়ে যাই’।

মোস্তফার কথা বিশ্বাস করে তাকে নিয়ে তার দেখানো মতে একটি ফাঁকা রাস্তায় মাটির নিচে থেকে গ্রিল ভাঙার জিনিসসহ আরো কিছু আলামত উদ্ধার করে থানায় গিয়ে দেখলাম ডিসি সাহেব তখনও থানায় বসে আছেন। তিনি আমাদের বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিলেন। সেই রাতেই তিনি হুমায়ুন খান পন্নি সাহেবের বাসায় ফোন করলে ভদ্র মহিলা তার জার্মান স্বামীকে নিয়ে থানায় এলেন। তাঁর লুন্ঠিত মণিমুক্তা দেখে মহা খুশি হলেন। তাঁর জার্মান স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের ভুয়সী প্রশংসা করলেন।

সকালে চীফ কনজারভেটর সাহেবের বাসায় ফোন করলে তাঁরা থানায় এলেন। তাঁদের লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার করায় সন্তোষ প্রকাশ করলেন। ডাকাতির ঘটনার পর ম্যাডামকে আমি লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধারের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তিনি আমার দেওয়া মিথ্যা আশ্বাস বিশ্বাস করে আমাকে একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন। ডাকাতি হওয়ার পর এভাবে মালামাল উদ্ধারের ঘটনা খুব কমই ঘটে। লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধারের পর থেকে ম্যাডাম আমাকে আরো অনেক আপন করে নিলেন। সেই থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে আমি ‘খালা আম্মা’ ডাকতাম। মাঝে মাঝে তাঁর বাসায় আমাকে দাওয়াত করতেন। একদিন তার বাড়িতে গানের আসরে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী নীনা হামিদের সাথে আমাকে তাঁর বোনের ছেলে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

চাঞ্চল্যকর দুটি ডাকাতি মামলার ঘটনা দ্রুত উদঘাটন করায় সমগ্র ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। সকল খবরের কাগজে ফলাও করে আমার নাম প্রচার হলো। তখনকার সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সাংবাদিক জনাব যাকারিয়া মিলন ভাই ও সাপ্তাহিক অপরাধ জগৎ পত্রিকার সাংবাদিক ওয়াহিদ মুরাদ ভাই তাদের পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদন ছাপলেন।

বেশ কিছুদিন পর দেখলাম- দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ঐ প্রতিবেদনের উপর তৎকালীন মাননীয় আইজিপি এ আর খন্দকার মহোদয়ের নিজের হাতে লেখা একটি পেপার কাটিং। তাতে লেখা ছিল- কমিশনার ডিএমপি, এই অফিসারকে পুরস্কৃত করুন। এই পেপার কাটিং এর ফটোকপিতে মাননীয় পুলিশ কমিশনার ও ডিসি সাউথ সাহেব ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেবকে লিখেছিলেন- Submit reward role. ওসি সাহেব সেই Reward role তৈরী করে ডিসি সাউথ মহোদয়ের কাছে হাজির করতে আমাকে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সেই Reward role আর কখনও তৈরী করা হয়নি। আমার Reward টাও কপালে জোটেনি। কারণ আমি কাজ নিয়ে বেশি মেতে থাকতে পছন্দ করতাম। পুরস্কার বা কোন প্রাপ্তি নিয়ে তেমন মাতামাতি করতাম না।

এখানে একটু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতেই হয়। এই ডাকাতির ঘটনায় জড়িত মইজা ও বদ্দা মোস্তফা এর আগে জেলে থাকাকালীন একে অপরের সাথে ‘বাপ-ছেলে’ সম্পর্ক তৈরী করেছিল। কিন্তু এবার জেলে গিয়ে তারা কয়েকবার মারামারি করেছিল। কারণ, বদ্দা মোস্তফা আগেরবার মইজাকে ছেলে ডেকে জেল থেকে জামিন করিয়ে একসাথে ডাকাতি শুরু করেছিল। কিন্তু মইজা ধরা পড়ার পর পুলিশের সামান্য পিটুনির ভয়ে মোস্তফাকে ধরিয়ে দেওয়া ও তার দুর্বল পয়েন্ট ‘মুখে গামছা বেঁধে পানি ঢালা’র কৌশল বলে দেওয়ায় সে মারাত্মক মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এসব কথা জেলখানা থেকে মইজা আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল। সে আরো লিখেছিল- মোস্তফা জামিনের জন্য এক লক্ষ টাকার চুক্তি করেছে। তাড়াতাড়ি সে জামিন পেয়ে আপনার বড় ধরণের ক্ষতি করবে। মইজার চিঠি পেয়ে আমি সামান্য ভয় পেলেও কাউকে বলিনি।

এই ডাকাতির ঘটনা ছিল ১৯৯০ সালের। ২০০৮ সালে আমি শ্রীনগর থানার ওসি থাকাকালীন মইজা, উজ্জ্বল ও তাদের বাবা চুন্নু মিয়ার কথা মনে করে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। তখন তাদের বাড়ি যেতে বিল পাড়ি দিতে হয়নি। রাস্তাঘাট মোটামুটি ভাল ছিল। চুন্নু মিয়া অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। মারা যাওয়ার আগে তিনি বাড়ির পাশে একটি ছোট মসজিদ তৈরী করেছিলেন। সেই মসজিদের পাশে তার কবরটি বেশ দর্শনীয় আকারে পাকা অবস্থায় দেখলাম। উজ্জ্বল তখন মালয়েশিয়ায় ছিল। তার আগের সেই স্ত্রীকে (মইজার স্ত্রী) ডিভোর্স দিয়ে আর একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সেই স্ত্রীর দুটো ছেলে মেয়ে দেখে তাদেরকে আদর করলাম। মইজার খবর নিয়ে জানতে পারলাম সে দীর্ঘদিন জেল খেটে জেল থেকে বের হয়ে মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো। কিন্তু এলাকার লোকজন দেখলেই তাকে সন্দেহ করতো। সে এলাকায় গেলেই চুরি ডাকাতি বেড়ে যেতো। তাই এলাকার লোকজন তাকে কয়েকবার গণপিটুনি দিয়েছিল। অনেকে জানালো মাঝে মাঝে তাকে ঢাকা শহরে ও বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার উপর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছে। সবকথা শুনে ঐ বাড়িতে আমার যাওয়ার কারণ কাউকে না জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম।

আনন্দ

ডাকাতি মামলার তথ্য উদঘাটন করতে পারা পুলিশের জন্য অনেক সম্মানজনক। তাই এই মামলার ঘটনায় আমি মনে মনে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম।

এই মামলার তদন্তে উর্ধতন অফিসার বৃন্দের সুনজরে আসতে পেরে পরবর্তী জীবনে তার সুফল অনুভব করেছিলাম।

অধিকাংশ ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগীরা তাদের লুণ্ঠিত মালামাল উদ্ধার হওয়ার চেয়ে বরং হয়রানি হন। কিন্তু এই মামলায় ব্যতিক্রমী ফল হওয়ায় ভুক্তভোগীদের মানসিক শান্তি দেখে আমিও তৃপ্তি পেয়েছিলাম।

উজ্জ্বলকে ডাকাতি মামলায় চালান না দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম বলে পরবর্তীতে সে মালয়েশিয়া গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল।

দুর্ধর্ষ ডাকাত মোস্তফা হয়তো এতদিনে জামিন পেয়েছে বা সাজা খেটে জেল থেকে বের হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমার কোন ক্ষতি হয়নি।

বেদনা

এই ঘটনাটি সাফল্যে ভরা। তাই বেদনার তেমন কিছু নেই।

তবে এই ঘটনার সত্যতা রক্ষা করতে গিয়ে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করতে হয়েছে এজন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। চলবে…

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!