বন্দর কর্তৃপক্ষের জোড়ালো তাগিদে এক মাস ১৩ দিন পর উদ্ধার হলো ডুবন্ত কার্গো জাহাজ এম,বি ফারদিন- ১। সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে একটি উদ্ধারকারী জাহাজের মাধ্যমে টেনে এটিকে বন্দর চ্যানেলের কানাইনগর এলাকার পশুর নদীর চরে উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ওই সময় ডুবে যাওয়া কার্গোটিতে নিখোঁজ থাকা সুকানি মোঃ মহিউদ্দিন (৬০) এর সন্ধান মেলেনি। ডুবন্ত কার্গো জাহাজের হ্যাচের মধ্যে মহিউদ্দিনের মরদেহ আটকে থাকতে পারে বলে ধারণা করছিলেন ডুবুরি দল ও নিখোঁজের পরিবার সদস্যরা। তবে জাহাজটি উত্তোলন হলেও মহিউদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়নি।
ডুবন্ত কার্গোটির উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের ভাই ভাই স্যালভেজ কোম্পানীর মালিক মোঃ আঃ সাত্তার জানান, হাড়বাড়িয়ার ১২ নম্বর এ্যাংকোরেজ এলাকায় ডুবে যাওয়া কার্গো জাহাজটি উত্তোলণের জন্য আমার প্রতিষ্ঠানের সাথে কার্গো মালিকের চুক্তিপত্র হয়। প্রথমে ডুবন্ত ওই কার্গোটি থেকে অন্য একটি কার্গোতে কয়লা অপসারণ করা হয়েছে। ডুবন্ত কার্গোতে যে পরিমান কয়লা ছিল পাম্প মেশিনের সাহায্যে গত ১৫ ডিসেম্বর সম্পুর্ণ কয়লা অপসারণ শেষ হয়। পরে শুধু কার্গোটি উত্তলনের কাজ শুরু করা হয়। সেখান থেকে প্রায় ১০ থেকে ১২ দিন সময় ধরে ডুবন্ত কার্গোটি উঠিয়ে দুইটি নৌযানের সহায়তা ভাসিয়ে এনে সোমবার রাতে মোংলার কানাইনগর এলাকায় পশুর নদীর চরে রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ডুবন্ত কার্গো উঠানোর পর দেখা যাচ্ছে এটি বিদেশী জাহাজের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যাওয়ার পর ওই বিদেশী জাহাজটি ডুবন্ত কার্গো জাহাজটির উপর দিয়ে চলে যাওয়ায় পাঙ্খার আঘাতে দুমড়ে-মুছড়ে গেছে এ কার্গোটি। যার কারণে কার্গোতে থাকা ৭ নাবিকের মধ্যে ৫ জনই নিখোঁজ হয়েছে।
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ এলাকার এম,বি ফারদিন-০১ এর মালিক মোঃ ফজলুল হক খোকন বলেন, আমার এই বাল্কহেডটি অন্য আরেকজনের কাছে ভাড়া দেওয়া ছিলো। তার কাছে থাকা অবস্থাতেই মোংলা বন্দরে দুর্ঘটনার শিকার হয়। যারা উত্তোলন করেছে তারা বলেছে এই কার্গো দিয়ে আর কোন কাজ বা নৌপথে চলানো সম্ভব হবেনা, এখন কেটে বিক্রি করা ছাড়া উপায় নেই।
গত ১৫ নভেম্বর রাতে প্রায় সাড়ে ৬শ মেঃ টন কয়লা বোঝাই কার্গো জাহাজ এম,বি ফারদিন-০১ বন্দর ছেড়ে যাওয়ার সময় বিদেশী একটি জাহাজের ধাক্কা লেগে মোংলা বন্দরের হাড়বাড়িয়ার ১২ নম্বর এ্যাংকোরেজ বয়া এলাকায় ডুবে যায়। দুর্ঘটনার সময় ওই কার্গোর ২ জন নাবিক জীবিত উদ্ধার হলেও নিখোঁজ থাকে ৫ জন নাবিক। তার মধ্যে থেকে ৪ জনের লাশ বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করা হলেও এখনও নিখোঁজ রয়েছেন লস্কর মোঃ মহিউদ্দিন।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ডুবন্ত কার্গোটিতে নিম্নমানের পিট কয়লা ছিল। এসব কয়লা ঢাকাসহ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন ইটভাটা ও বিভিন্ন লোহার কারখানায় ব্যবহারের জন্য নেয়া হচ্ছিল। আমদানীকরা এ কয়লায় রয়েছে সালফার, সিসা, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, পারদ, নিকেল, সেলেনিয়াম, বেরিলিয়াম, রেডিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও আর্সেনিকের মতো ক্ষতিকর সব পদার্থ। দীর্ঘ সময় কয়লাগুলো পানিতে ভিজে থাকার কারণে এসব ক্ষতিকারক পদার্থ পানির সঙ্গে মিশে গেছে। আর এখন যেভাবে পাইপ দিয়ে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে কয়লা উঠবে ঠিকই, কিন্তু এর ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ পানি ও মাটিতে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করবে। এতে অঙ্কুরোদ্গম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কয়লাবোঝাই জাহাজটি যে স্থানে ডুবেছে, সেখানে ইরাবতী ডলফিনের বিচরণক্ষেত্র। লবন পানির কুমিরের প্রজননেরও সময় এটা। ফলে কয়লার বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে ডলফিন ও কুমিরের জীবনচক্র ব্যাহত হতে পারে। অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজননও হুমকিতে পড়বে। একই সঙ্গে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে, কয়লা বোঝাই ডুবন্ত কার্গো জাহাজ উত্তোলনে দেরি হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান লায়ন ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কার্গোটি ডুবে যাওয়ার সাথে সাথে উত্তোলন করতে পারলে ভাল হতো। কয়লার জাহাজটি উদ্ধারে দেরি হওয়ায় সুন্দরবনের জলজ-প্রাণীজ ও জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এ কয়লায় সালফারের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করে থাকে। এছাড়া রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনে এ ধরণের দুর্ঘটনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে। তাই বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলকে এব্যাপারে সচেতন হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
খুলনা গেজেট/ এস আই