খুলনা, বাংলাদেশ | ১৯ ফাল্গুন, ১৪৩১ | ৪ মার্চ, ২০২৫

Breaking News

  চট্টগ্রামে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত ২, গুলিবিদ্ধ ৪
  ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা প্রদান বন্ধ করলেন ট্রাম্প

দূরত্ব

রুমা ব্যানার্জি

সম্পর্ক মানে আবেগ আর মায়া। এই দুটিকে হৃদয়ে সযত্নে লালন করতে হয়। সম্পর্ক থাকলে আমরা আবেগ কিংবা মায়াটা প্রকাশ করি আর সম্পর্ক না থাকলে আবেগ আর মায়াটাকে নিজের বুকের খাঁচায় শিকল দিয়ে বন্দী করে রাখি।

কত সহজে আমরা বদলে যাই সময়ের সাথে সাথে, ঠিক যেন ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে ফেলার মত। ইগো, আত্মসম্মানবোধ কিংবা অহংকার থেকে তৈরী হয় সম্পর্কের দূরত্ব এবং নীরবতা।

সম্পর্কের দূরত্ব ও নীরবতা সমানুপাতিক। দূরত্ব যত বাড়ে নীরবতা ততই বেড়ে যায়। চলে যাওয়া সময়ের সাথে সাথে যখন সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে যায়, তখন ভালোবাসা, ভালোলাগা থাক কিংবা না থাক, সম্পর্কটা আর থাকে না, থেকে যায় অভ্যাস।মানসিক দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে সম্পর্কে নীরবতাও বাড়তে থাকে। দূরত্ব বেড়ে গেলে একসময় তা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও নীরবতা ভেঙ্গে আগের জায়গায় ফিরে আসা বেশীরভাগ সময়ই অসম্ভব হয়। এই দুরত্ব নিয়ে অনু গল্প……..

 

দূরত্ব ১

একটি চড়ুই পাখির গল্প

—পাপাই তুমি রেডি?
—–হ্যাঁ বাবাই,
মাম্মা তাড়া দিল —– তাড়াতাড়ি এসো ,

আমি পাপাই,বয়স পাঁচ, আজ আমি হোস্টেলে চলে যাচ্ছি সবাইকে ছেড়ে। এটা আমি কোনোদিন চাই নি গো। আমি চাইতাম বাবাই আর মাম্মা ঠাম্মা, দিদুন সবার সঙ্গেই থাকতে। কিন্তু বাবাই আর মাম্মা, ওরা খালি ঝগড়া করতো।ঝগড়া করতে করতে যখন দুজনে আড়ি করে দিলো। ওদের ভাব করাতে উকিল আঙ্কেল ওদের বলেছিল এই কথাটা। কিন্তু ওরা শুনল না। আমরা সহজেই ভাব করি , বড়রা পারে না।কেন পারে না?

প্রথমে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।প্রথম যখন মাম্মা আর বাবাই’র আড়ি হলো তখন মাম্মা সারাদিন আমাকে কত আদর করতো, খেলত, বাবাই এসে বেড়াতে নিয়ে যেত, বাবাইয়ের নতুন বাড়ি যেতাম। কত্তো ভালোবাসতো দুজনে।আমি আর মাম্মা থাকতাম, আর বাবাই আসত ছুটির দিন।

তারপর আস্তে আসতে দুজনেই কেমন যেন হয়ে গেল।বাবাই আমাকে পার্কে নিয়ে ছেড়ে দিত আর নিজে মিলি অন্টির সঙ্গে বসে গল্প করত।মাম্মা ফোনে অনুজ আংকেল এর সঙ্গে সারাদিন কথা বলত। আমি একা একা খেলতাম, হোমওয়ার্ক করতাম। একা একা ইচ্ছেই করতো না পড়তে। তখন স্কুলের আণ্টি ওদের খুব বকলো। বকুনি খেয়ে দুজনেই আমাকে কি বকুনি দিল কি বলব। সব দোষ নাকি আমার। আমার জন্য ওদের জীবন আটকে গেছে এগুতে পারছেনা। আমি কিন্তু কিছু করিনি, তাও আমার দোষ হল।

এখন আমি বুঝে গেছি এরা কেউ আমাকে চায় না তাই আমি হোস্টেলে চলে যাচ্ছি, অনেক দূরে, সেখানে অনেক বন্ধু থাকবে, শুধু বাবাই আর মাম্মা দূরে চলে যাবে। অনেক দূরে……

 

দূরত্ব ২

বাঁধন

—–দেখো তো কে এলো এখন?
—- দেখছি । ওহ্ ভ্যাবলা তুই , তা এই সাত সকালে? কি মনে করে? আয় আয়, যখন এসেছিস, তাহলে ভিতরে এসে বোস, তোর কাকিমা কে ডাকি।
কথা শেষ হওয়ার আগে পরিচিত নারী কণ্ঠ ভেসে এলো
—– “হ্যাঁ গো, শুনছো, আমার হাত জোড়া, ভেতরে এসে একটিবার আমাকে উদ্ধার করবে দয়া করে। সক্কাল থেকে তোমার আদিখ্যতায় তো গগন ফাটছে, বাড়ির চালে কাক চিল ও বসবে না এবার থেকে ।”

ভ্যাবলার কাকাবাবু ভিতরে গিয়ে মিনমিন করে বললেন
—– এই শোনো, ভ্যাবলা এসেছে, বাইরের ঘরে বসে আছে।একটি বার এসো।

—–আসুকগে, আমি কি করবো শুনি?এখন কিন্তু তোমার ঐ ন্যাকা আবদার শুনতে পারবো না এই স্পষ্ট বলে দিচ্ছি।থেকে থেকে টাকা দাও , খাবার দাও, গুষ্টির পিন্ডি দাও । ও সব চলবে না। বুঝলে।

—- আহ্ গিন্নি আস্তে, শুনতে পাবে যে….

পাক। আমি কি ভয় পাই নাকি? পত্রপাঠ বিদেয় করো বলে দিচ্চি। বলে নিজেরে জ্বালায় জ্বলছি আবার উনি এলেন শিবের গাজন গাইতে। পেটে গামছা বেঁধে লেখা পড়া করা হচ্চে । বচ্ছর বচ্ছর পাশ দিয়ে মাথা কিনে নিয়েছে এক্কেবারে । এই দুর্মূল্যের বাজারে এক নয়া পয়সাও আমি বাজে খরচ করতে পারবো না। এই বলে দিলাম।

আহ্ গিন্নি। কি হচ্ছে টা কি ? যতই হোক আমার নিজের রক্ত। একটাই তো দাদা ছিল আমার। ওনার জন্য আজ আমি এখানে।সে কি ভুলতে পারি?
—তবে আর কি কোলে তুলে নাচো। এই নাও এক গেলাস জল, খাইয়ে বিদেয় কর ভালো চাও তো।

জল নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভ্যাবলা উঠে কাকাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, সরকার মশাই একটু হকচকিয়ে গেল। নিজের অজান্তেই মাথায় হাত রেখে বললেন, মঙ্গল হোক।

ভ্যেবলা নরম সুরে বলল, আসলে আজ আমার স্কুলের চাকরির প্রথম দিন, বাবা তো নেই তাই মা বললো তোমাকে আর কাকিমা কে প্রণাম করে তবে যেতে। মা বলে সম্পর্ক কে বেঁধে রাখতে হয়। দূরত্বটা মনের , সম্পর্কের তো নয়।

দূরত্ব ৩

দেওয়াল

আয়নার সামনে প্রায় উঠে যাওয়া চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল প্রান্তিক।
পিছন থেকে অধিশ্রী কুণ্ঠিত গলায় বলল —-“আমি কিন্তু রেডি ”
—— এটা পরে যাবে? কোনো জ্ঞান নেই রং সম্পর্কে? যেখানে যা ইচ্ছে পড়লেই হল? ডিসগাস্টিং।

অধিশ্রী মনে মনে জানত প্রান্তিক এমনটাই বলবে, তাও বললো—- কেন বেশ তো দুধে আলতা রং…..আসলে এটাই তার নিজের পছন্দে রং,প্রান্তিক সেটা এত বছরেও জানে না। অনেক বছর কিনেছে কিন্তু পরা হয়নি।আজ এতদিন পরে ভেবেছিল, যাকগে,…. অধিশ্রী তো একজন আদর্শ স্ত্রী তাই সে প্রতিবাদ করে না।তাই আজও সে নীরব।

নিজের গেরুয়া রঙের শার্ট টা আর একবার ভালো করে দেখে, বিদেশি পারফিউম গায়ে ছড়াতে ছড়াতে প্রান্তিক বলল——-সব রঙ সবার জন্য নয় এটা তোমার মত মোটা মাথায় ঢুকবে না। নিজের বয়সের গাছ পাথর নেই, এখনও ছুঁড়ি সাজার সখ?আর এটা কি সেজেছে, এই বয়সে কি কাজল পড়লে মানায়? মোবাইল ঘেঁটে ঘেঁটে সব গেছে।

অধিশ্রী এটা অভ্যাস হয়ে গেছে, বেরুতে গেলে নিজের না প্রান্তিকের পছন্দের সাজ সাজতে হয়। অফ হোয়াইট শাড়িটা সে বের করেই রেখেছিল। পাল্টে নিল বিনা বাক্যে। সে যে আদর্শ স্ত্রী।

নিজের সাজটা আর একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে প্রান্তিক উঁচু গলায়, পাশের ঘরে অধিশ্রী কে বললো, ——– ওখানে গিয়ে আবার বোকার মত সব ব্যাপারে হাসবে না আর হামলে পড়ে খাবে না । কাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে কি ভাবে বলতে হবে এত দিনেও শিখলে না। তোমাকে মানুষ করতেই পারলাম না এত দিনেও, প্রান্তিকের গলায় ক্ষোভ।

কষ্টটা গলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে দম বন্ধ করে দিচ্ছিল অধিশ্রীর। এমনিতেই কথা কম বলে সে ইদানিং একে বারেই চুপ করে গেছে। বলে লাভ কি? বোঝার মত মানসিকতা নেই প্রান্তিকের।তার থেকে রোজ নিজের মনের দেওয়ালটা আরো কিছুটা তুলে দেয়। সেই দেওয়ালে মাথা খোঁড়ে সব অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমান। মাঝে মাঝে এই অদৃশ্য দেওয়ালের আঁচ পায় প্রান্তিক কিন্তু বিশেষ আমল দেয় না।

বাইরের সবার কাছে তারা আদর্শ স্বামী স্ত্রী। শুধু বিছানাটা জানে দুই বালিশের মধ্যে দূরত্ব ভৌগোলিক নয় মানসিক। সেখানে আছে অতলান্ত নীরবতার কৃষ্ণ গহ্বর যেখানে রোজ একটু একটু করে তাদের সম্পর্ক নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!