সূর্য ওঠার আগেই জেলেরা সাগর মোহনায় মাছ শিকার করে সেই মাছ টলারযোগে নিয়ে চরে আসেন। চরে টলার আসা মাত্রই দু’জন জেলে কাঁধে বাশ চাপিয়ে মাছ ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে রওনা হয় শুঁটকি পল্লীতে। তারপর তা রোদে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়া করা হয়। দিন-রাত এসব জেলেরা সাগরে নেমে মাছ সংগ্রহ করছেন এবং একই সঙ্গে তা শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করছেন। জেলেদের এমন কমব্যস্ত দৃশ্যের দেখা মেলে সুন্দরবনের দক্ষিণে অবস্থতি দুবলার চরে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুবলার চরের অস্থায়ী শুঁটকি পল্লীর ঘর গুলো তৈরি করা হয়েছে ছোন ও বাঁশ দিয়ে। সাগর থেকে ধরে আনা মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম পড়েছে এ পল্লীতে। লইট্যা, ছুরি, চিংড়ি, রূপচাঁদা, খলিসা, ইছা, ভেদা, পোয়া, দাইতনাসহ অন্তত একশ’ প্রজাতির শুঁটকি তৈরি করা হয় এই পল্লীতে। বাঁশের মাঁচা করে ও পাটিতে খোলা আকাশের নীচে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। এখানে ভ্রমণে আসা পর্যটকরা ভীষণ মুগন্ধতা নিয়ে শুঁটকি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। সাগর থেকে মাছ ধরে জেলেদের ফিরে আসার দৃশ্য ও শুঁটকি তৈরি এবং বেচা বিক্রির দৃশ্য সত্যিই মনোলোভা ও উপভোগযোগ্য।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে মেহেরআলীর খাল, আলোরকোল, মাঝেরচর, অফিসকেল্লা, নারিকেলবাড়িয়া, মানিকখালী, ছাফরাখালী ও শ্যালারচর ইত্যাদি এলাকায় অস্থায়ী জেলে পল্লী স্থাপিত হয়। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে এ চরগুলো অবস্থিত। চার মাস তারা মাছকে শুঁটকি বানাতে ব্যস্ত থাকেন। চলতি শুঁটকি মৌসুমকে ঘিরে ভীষণ জমজমাট হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের দুবলার চরের জেলে পল্লী। এখন পুরোদমে শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শুরু হয়েছে। সমুদ্র থেকে মাছ এনে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করছেন হাজার হাজার জেলেরা।
প্রতি বছর কার্তিক মাসে (খ্রিস্টীয় নভেম্বর) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং পূণ্যস্নানের জন্যও দ্বীপটি বিখ্যাত। যদিও বলা হয়ে থাকে, ২০০ বছর ধরে এ রাসমেলা হয়ে চলেছে , তবে জানা যায়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে হরিচাঁদ ঠাকুরের এক বনবাসী ভক্ত, নাম হরিভজন (১৮২৯—১৯২৩), এই মেলা চালু করেন। প্রতিবছর অসংখ্য পুণ্যার্থী রাসপূর্ণিমাকে উপলক্ষ করে এখানে সমুদ্রস্নান করতে আসেন। দুবলার চরে সূর্যোদয় দেখে ভক্তরা সমুদ্রের জলে ফল ভাসিয়ে দেন। সেই থেকে দুবলার চরের প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় রাসমেলা। আর সে সময় বেশি শুঁটকি বিক্রি হয়। কিন্তু এবার করোনার কারণে শুধু রাস উৎসব হয়েছে। মেলা না হওয়ায় লোক সমাগম কম হয়েছে। এতে শুঁটকি বিক্রিও কমে গেছে।
মাছ শুকানোর সময় কথা হয় শুঁটকি তৈরির কারিগর খান জাহান আলী নামের এক জেলের সাথে। তিনি জানান, কার্তিক মাসে এখানে আসেন। আর চৈত্র মাসে চলে যান। সাগর মোহনায় তারা মাছ শিকার করেন। তারপর তা রোদে শুকিয়ে শুঁটকি প্রক্রিয়া করা হয়।
শুঁটকি ব্যবসায়ী দেবু বিশ্বাস বলেন, দুবলার চরের শুটকি মাছ চট্টগ্রাম, সৈয়দপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। করোনার কারণে এবার শুঁটকির দাম কিছুটা কম। লইট্যা শুঁটকি পাইকারি এক মণ বিক্রি হয় ১১-১২ হাজার টাকা। বড় ছুরি মাছ ৩০-৩৫ হাজার, ছোটটা ৩৮ হাজার টাকা। রূপচাঁদা বড়টা ৮০ হাজার টাকা মণ। ছোটটা ৪০ হাজার। ইছা শুঁটকি বড়টা ৪৪ হাজার, ছোটটা ২৪ হাজার টাকা মণ।
তিনি জানান, প্রতিবছর নভেম্বর থেকে মার্চ পযর্ন্ত চলে এ অস্থায়ী পল্লীতে মাছ শুটকির কাজ। নির্ধারিত রাজস্ব দিয়ে অস্থায়ী শুটকি পল্লীতে অস্থায়ী ঘর করে সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে।
শুঁটকি পরিবহন প্রতিষ্ঠান খান শফিউল্লাহ ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার কুতুব উদ্দিন মোল্লা বলেন, আমরা প্রতিবছর গড়ে ১০-১২ হাজার মন শুঁটকি পরিবহন করে থাকি। আমাদের মতো ৮টি প্রতিষ্ঠান দুবলার চর থেকে শুঁটকি পরিবহন করে। তিনি জানান, প্রায় ১০ হাজার জেলে ও বহরদার এ ব্যবসার সাথে জড়িত।
শুঁটকি ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা বলেন, সুন্দরবনের দুবলার চরের শুটকি পল্লী থেকে শুঁটকি নিয়ে সৈয়দপুর, রংপুর, তিস্তা ও চট্টগ্রামের মোকামে সরবরাহ করি। করোনার কারণে এবার শুঁটকির দাম অনেক কম। মোকামে মাছ পাঠিয়েছি তারা অনেক দাম কম বলছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার শুটকি খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের টার্গেট ধরা হয়েছে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত ২০১৮-১৯ শুটকি আহরন মৌসুমে জেলেদের আহরিত ৪১ হাজর ৫৪ কুইনন্টাল শুটকি থেকে বন বিভাগ ২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ মৌসুমে ৪৪ হাজর ৭১৩ কুইনন্টাল শুটকি থেকে বন বিভাগ ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
খুলনা গেজেট /এমএম