১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযদ্ধের সময় মানবতার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা, রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী বাঙালি জাতির মেধাবী সন্তানদের হত্যা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সা প্রণয়ন করে পাকিস্তানী জেঃ রাও ফরমান আলী। বিশেষতঃ স্বাধীনতার উষালগ্নে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার যে নারকীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তাদের কাপুরুষতা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন সাংবাদিক। তার মধ্যে চার জনের ঠিকানা খুলনায়। পেশাগতভাবে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাতির জন্য শহিদ সাংবাদিকরা সুদূর প্রসারী ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭১ খুলনার চার জন শহিদ সাংবাদিকদের উত্তরসূরী হিসেবে আমরা গর্বিত। যেমন এখানকার মানুষ গর্ব করে বলে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি খুলনার মাটিতে। রাজনীতিক, সাংবাদিক, গবেষকসহ বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাদের অমর কীর্তি এবং দেশ প্রেমের উদাহরণ তুলে ধরা হলো।
সৈয়দ নজমুল হক
১৯৪১ সালের ৫ জুলাই তার জন্ম। পিতার নাম এমদাদুল হক এবং মাতার নাম শামসুন নাহার। খুলনার ফুলতলা উপজেলার পঁয়গ্রাম কসবা তার পৈত্রিক নিবাস। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি ভাইদের মধ্যে চতুর্থ। এই শহিদ সাংবাদিকের বড় মেয়ে সৈয়দা নাহিদ শাহীন, বড় ছেলে সৈয়দ মোর্তুজা নাজমুল এবং ছোট ছেলে সৈয়দ মুস্তফা নাজমুল। শৈশবে বরিশাল জেলার মঠবাড়িয়ায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা সরকারী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে বিএ অনার্স এবং একই বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। ক্রীড়া জগতে তার পারদর্শিতা কম ছিল না। ১৯৬০-৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, ইতালি ও সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র সফর করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের পত্রিকা তিস্তা সম্পাদনা করেন। অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সংস্কৃতি বিষয়ে ডন, পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা টাইমস, ওয়েভ এবং ইউনিটি ইত্যাদি পত্রিকা প্রবন্ধ লিখতেন।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
১৯৬৭ সালে সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং কেন্দ্রীয় সরকার ইনফরমেশন সার্ভিসের জন্য মনোনীত হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান প- করা মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ এনে সরকার তাকে সি এস পিতে যোগদান করার সুযোগ দেয়নি। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা) প্রত্যাহার হয় ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই মামলা থেকে মুক্ত হবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান ৬৯ সালের অক্টোবর মাসে যখন ইউরোপ ও লন্ডন সফরে যান তখন তার একান্ত সচিব হিসেবে সৈয়দ নজমুল হককে নিয়ে যান (বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউটের প্রকাশনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ সাংবাদিক)। তিনি বিদেশে সেই সময় ছায়ার মত বঙ্গবন্ধুর সাথী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্নেহের নিদর্শন স্বরুপ সৈয়দ নজমুল হককে একটি পাইপ উপহার দেন।
এ প্রসঙ্গে খ্যাতিনামা সাংবাদিক কে জি মুস্তফা লিখেছেন ১৯৬৯ সালের শেষ দিকে করাচীতে ওয়েজ বোর্ডের সভা শেষে ঢাকায় ফিরছিলাম। বিমানে উঠেই দেখি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ও সাংবাদিক নজমুল হক। আমাকে দেখেই নজমুল হক হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানান। আমিও তাদের সহযাত্রী হিসেবে পেয়ে দারুণভাবে খুশি। গল্পের এক ফাঁকে নজমুল এক প্যাকেট স্ট্রেট এক্সপ্রেস সিগারেট আমার হাতে গুঁজে দিল। বঙ্গবন্ধু দেখে ফেলে চট করে রসিকতা করে বলেন কি হে লিডারকে ঘুষ দেয়া হচ্ছে বুঝি? আর সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে সবার কী প্রাণখোলা হাসি। তারপর নজমুল হক দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক আলোচনা করল আমার সাথে। বিদেশ সফরকালে বিবিসি ও লন্ডন টেলিভিশনে অংশগ্রহণ করে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ ও প্রচার করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেবার আগে বঙ্গবন্ধু যথাযথ রিপোর্ট করার জন্য নজমুলকে ডেকে পাঠান।
পি আই বি’র প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন পেয়ে নজমুল হক চলে যান। ঐতিহাসিক ভাষণের যথাযথ রিপোর্ট করে ৭ মার্চ রাতে বাসায় ফেরেন। ঐ সময় তিনি পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নজরে পড়ে যান। যুদ্ধ চলাকালীন তার লেখনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে একমত পোষণ করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দেন এবং দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনী বিদেশী সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছে দিতেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি গিয়াস কামাল চৌধুরী তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস নজমুল হক পিপিআই এর চীফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও সামরিক গোয়েন্দাদের এড়িয়ে হোটেল ইন্টারকনে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য’র তথ্য পৌঁছে দিতেন।
(adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
তিনি নিজে কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, হংকং এর এশিয়ান নিউজ এজেন্সির ঢাকাস্থ সাংবাদিকতার এবং ঢাকা টাইমসের সিটি এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তানীদের রোষানলে পড়েন। নানা অভিযোগে তাকে ঢাকা থেকে ৬ আগস্ট গ্রেফতার করে পশ্চিম পাাকিস্তানের কারাগারে পাঠানো হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তাকে উৎপীড়ন করে। তিনি সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। ২০ সেপ্টেম্বর তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে এনে নজরবন্দী করে রাখে। নজমুল হক যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন আমাদের অনেক বাঙালিই তা করতে পারেননি। তারা প্রাণের ভয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু নজমুল তা করেন নি।
তিনি স্ত্রী সুলতানাকে বলতেন, দেশ স্বাধীন হবেই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে পারব না। স্বাধীন বাংলায় আমি আমার ছেলেমেয়ের কাছে দালাল, বিশ্বাসঘাতক পিতা বলে পরিচিতি হতে পারব না। পুনরায় ১৯ অক্টোবর তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গোপন বিচারে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য অকথ্য নির্যাতন করে। তা সত্বেও তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেননি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানী বাহিনী আবার তাকে ঢাকায় ফেরত আনে। শত উৎপীড়ন শত ভীতি, শত প্রলোভন পারেনি সাংবাদিক নজমুলকে টলাতে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর রাত চারটার দিকে তিনি পুরানা পল্টনের বাসায় ঘুমিয়ে ছিলেন। আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তান বাহিনী তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়।
সেই সময় পাশের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদ অপহরণকারীদের প্রত্যক্ষ ও নির্ণয় করেন। পরিবার শত খোঁজাখুজির পরও শহিদ নজমুল হকের সন্ধান পায়নি। স্বাধীনতার পর তার বড় ভাই ও স্ত্রী অপহরণকারীদের সনাক্ত করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর দুই জল্লাদ লন্ডনে পালিয়ে যায়। তার মধ্যে একজন হচ্ছে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তাদের দু’জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- নিশ্চিত করার আদেশ দিয়েছেন। মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত আশরাফুজ্জামান আমেরিকায় এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীন ইংল্যান্ডে পালিয়ে যায়।
খুলনা গেজেট / এমএম