দুই ইস্যুতে উত্তপ্ত দেশের শিক্ষাঙ্গন। একদিকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষকরা, অন্যদিকে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। দুই ইস্যুতে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
আপিল বিভাগে কোটা বাতিলের রায় বহাল রাখার আদেশ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বৈঠকটি বাতিল হওয়ার পর এ আন্দোলন সহসায় থামার কোনো লক্ষণ নেই। রায় ও সভা বাতিলের কারণে আগামী সপ্তাহে আবার উত্তাপ ছড়াবে ক্যাম্পাসে-ক্যাম্পাসে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোটা আন্দোলনের মধ্যে আগুন ঘি ঢেলেছে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) আপিল বিভাগ থেকে কোটা বহাল রাখার আদেশে। ফলে সহসায় এ আন্দোলন থেকে সরছেন না শিক্ষার্থীরা।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয় জানতে চাইলে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামানো বা সমাধান করা কোনটিই ইউজিসির এখতিয়ারের মধ্যে নেই। শিক্ষকদের বিষয়টি সরাসরি একটি আর্থিক সংক্রান্ত। এটি কেবল সরকারের সিদ্ধান্ত বা পলিসির ব্যাপার। অন্যটি আদালতের ব্যাপারে। তাই আমরা চাইলেও বিষয়টি সমাধানের কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না। তবে সব বিষয়ে আমরা নজর রাখছি। শিক্ষাঙ্গন কোনো অবস্থায় অচলাবস্থা তৈরি হোক সেটা কাম্য নয়।
শিক্ষকদের আন্দোলনের আগের দিন গত রোববার (৩০ জুন) এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানিয়েছেন, শিক্ষকদের দাবি আদায় হওয়া, না হওয়ার ইস্যুতেই আমার কিছু করার নেই। এটা সরকারের নির্বাহী আদেশে হয়েছে। এটার কোনো পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। তবে, তাদের আন্দোলনের দিকে নজর রাখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চারদিন পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থা জানতে আজকে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান গণমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষকদের আন্দোলন প্রশমিত করার দায়িত্ব নিয়েছে সরকারের শীর্ষ মহল। এটা সরকারের পলিসির বিষয়। এছাড়া সরকারি চাকরিতে কোটা আদালতের ইস্যু হওয়া তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলছেন, এ আন্দোলন আস্তে আস্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থীরা সারা দেশের আন্দোলন করছে, সরকার যদি এখনই গুরুত্ব না দেয় তাহলে এসব আন্দোলনগুলো পরবর্তী সময়ে সরকারের জন্য বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে। যদিও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী নেতাদের অভিযোগ, এই আন্দোলনে বিএনপিসহ সরকার বিরোধীদের ইন্ধন রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে যুক্ত আন্দোলন এর আগে কখনও হয়নি। তাই এ আন্দোলনকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সারা দেশে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে একসঙ্গে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এর আগে এভাবে কখনও হয়নি। তাই এটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তার মতে, শিক্ষকদের আন্দোলন প্রশমিত করতে পারে সরকার। এটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে কোটা বাতিলের আন্দোলন যেহেতু আদালতের বিষয় তাই সেটি আইনি সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখনিই থামানো উচিত।
জানা গেছে, এই সরকারের মেয়াদে ছাত্র-শিক্ষকদের বিভিন্ন আন্দোলন সামাল দিয়েছে সরকার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আন্দোলন হয়েছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন। একটিতে গোটা দেশ অচল হয়ে গিয়েছিল, আর কোটা বিরোধী আন্দোলনে উচ্চ শিক্ষাঙ্গন স্থবির হয়ে যায়। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং সমস্ত কোটা বাতিল করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য কোটা পুনরায় চালু হয়। সেই কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।
সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে টানা চতুর্থ দিনের মতো কর্মবিরতি করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটাতে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে সেই সভা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে।
সভায় যেহেতু হয়নি তাই আগামী সপ্তাহ থেকে ফের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব নিজামুল হক ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আমাদের সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে সেটি স্থগিত করা হয়েছে। সভা কবে হবে, তা পরে জানানো হবে। সভা আমরা স্থগিত করিনি। আমাদের দাবি নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট সমাধান না দেওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।
দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ১ জুলাই থেকে যারা নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে ঢুকবেন তাদের জন্য পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর বিরোধিতা করে গত মার্চ থেকে আন্দোলন করছেন শিক্ষকরা। প্রথম দিকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, অর্ধদিবস কর্মবিরতির মতো নমনীয় কর্মসূচি করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না মেলায় গত ১ জুলাই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাত্মক অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতিতে নেমেছেন তারা।
তাদের দাবি, নতুন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা ৫৯ হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসরকালীন সময় ৬৫ বছর। কিন্তু নতুন স্কিমে অবসরকালীন বয়স ধরা হয়েছে ৬০ বছর। এক্ষেত্রে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বয়সসীমা কত হবে বা নতুন স্কিমে কীভাবে সামঞ্জস্য করা হবে সে ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। এছাড়া আরো কয়েকটি বিষয়ে জোর আপত্তি তুলে পেনশন স্কিমের বিরোধিতা করছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার দাবি মেনে নেওয়ার অন্যতম নজির ছিল ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন। সারা দেশে কোটাবিরোধী আন্দোলনে সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি মেনে নিয়েছিলেন এবং সমস্ত কোটা বাতিল করেছিলেন। কিন্তু একজনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জুন এক রিট মামলার নিষ্পত্তি করে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্য কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, তা বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। সরকার পক্ষ সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান।
বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন। এই আদেশের ফলে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (জাতীয় বেতন গ্রেড নবম থেকে ১৩তম) কোটা পুনর্বহাল হয়েছে। এতে টানা পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা ফিরে আসতে পারে।
আন্দোলনকারী বলছেন, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে এ আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা তৈরি করেছেন। তাদের দাবি, আদালত যাই বলুক না কেন, কোটা সংস্কার না করে আমরা ঘরে ফিরব না। কোটার কারণে মেধাবীরা সরকারিতে চাকরি বঞ্চিত হচ্ছে। আদালতের উচিত দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা শোনার।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, আপিল বিভাগ সরাসরি রায় দেয়নি। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেওয়া রায় আপাতত বহাল রেখেছেন। একইসঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল (নিয়মিত আপিল) করতে বলেছেন আদালত। তাই বিষয়টি এখনও বাতিল হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই আমরা আন্দোলন থেকে সরে যাব না।
খুলনা গেজেট/এএজে