ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রাশিয়া। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে জোর দিচ্ছে মস্কো। আর এর দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে মস্কোর শীর্ষ কূটনীতিক সের্গেই ল্যাভরভের। যিনি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।
বন্ধুর খোঁজে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চষে বেড়ানো ল্যাভরভ এবার পা ফেলবেন ঢাকায়। ঐতিহাসিক বন্ধুত্বে যেন কোনো পরাশক্তির কারণে চিড় না ধরে, সেই বার্তা দিতেই সংক্ষিপ্ত সফরে আজ (৭ সেপ্টম্বর) সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় আসবেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মস্কোর কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রথম বাংলাদেশ সফর করছেন।
ঢাকা-মস্কোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝালাইসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ল্যাভরভের এ সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনীতি সংশ্লিষ্টরা। ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, সব থেকেও রাশিয়া এখন অনেকটাই একা। রাশিয়া ইউরোপে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছিল, তা ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তলানিতে ঠেকেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ রুশদের একা করে দিয়েছে। মস্কোর সঙ্গে ঢাকার যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তা যেন অটুট থাকে এবং সামনের দিনেও বাংলাদেশ যেন দেশটির পাশে থাকে সেই বার্তা সম্ভাব্য বৈঠকগুলোতে ল্যাভরভ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
দায়িত্বশীল এক কূটনীতিকের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে রাশিয়া এখন অনেকটাই বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য প্রভাবশালী পরাশক্তির কারণে যেন ঢাকার অবস্থান পরিবর্তন না হয়, সেটাই হয়তো মস্কোর চাওয়া থাকবে। অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ কিন্তু পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে গেছে। আমরা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকছি। সেটা কিন্তু ঠিকই রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজকে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ল্যাভরভ তুলবেন বলে ইঙ্গিত রয়েছে। এক্ষেত্রে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মালামাল নিয়ে আসা রুশ জাহাজকে যে পরিমাণ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে, তা গুরত্ব দিয়ে আলোচনায় তুলবেন ল্যাভরভ।
এ প্রসঙ্গে দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, রাশিয়ার ইকোনোমিক অপারেটরস আছে। জাহাজ রুশদের একটি ইকোনোমিক অপারেটরস। রাশিয়ার যে ৬৯টা জাহাজে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেটা লিফট করার ব্যাপারে তারা বলতে পারে। তাদের যুক্তি হতে পারে ওটা দ্বিপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা, তা বাংলাদেশ কেন পালন করতে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কেন মানবে বাংলাদেশ, সেটাই হয়তো তাদের প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এটার উত্তর আমাদের কাছে নেই।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে তার একটি গুরত্বপূর্ণ কারণ মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখা। আর মস্কোর দিক থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেওয়ায় বিপদ হয়েছে ঢাকার জন্য। কেননা, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কূটনৈতিক পত্র পেয়ে রুশ জাহাজকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এক জাহাজকে কেন্দ্র করে ঢাকা-মস্কো সম্পর্কে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় এসে পৌঁছাবেন ল্যাভরভ। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে মোমেন-ল্যাভরভ দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হবেন।
দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উঠে আসবে। ঢাকা-মস্কো সম্পর্ক জোরদার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিস্থিতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনার টেবিলে থাকবে।
পাশাপাশি ইউক্রেন পরিস্থিতি, ভূ-রাজনীতি, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া জ্বালানি সহযোগিতা এবং রাশিয়া থেকে গম ও সার আমদানির বিষয়ে ঢাকা গুরুত্ব দেবে বলে মনে করছে সূত্রগুলো।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে নৈশভোজে অংশ নেবেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। খাওয়ার টেবেলি মোমেন-ল্যাভরভ জাতিসংঘ, আঞ্চলিক ও অন্যান্য বৈশ্বিক ফোরামে সমর্থন ও সহেযাগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে ইঙ্গিত রয়েছে।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে ঢাকা-মস্কোর মধ্যে কোনো চুক্তি হবে না। তবে দ্বিপক্ষীয় লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় দুই দেশের মধ্যে ঝুলে থাকা চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক মেরুকরণ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক হিসাব কষেই চলতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সম্পর্ক রক্ষায় করতে হচ্ছে ভারসাম্য। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সতর্ক থাকতে হচ্ছে ঢাকাকে।
ল্যাভরভ পরদিন শুক্রবার সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে নয়া দিল্লির উদ্দেশে রওনা করবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত মঙ্গলবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যেসব জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পর থেকে; সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা রাশিয়াকে একটা অনুরোধ করতে পারি, দ্রুত যেন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা যায়।
ল্যাভরভের সঙ্গে আলোচনায় খাদ্য, সার ও ফুয়েলের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, আমাদের যে সমস্যা রয়েছে তা আমরা তুলে ধরব।
একই দিন মস্কোতে ল্যাভরভের ঢাকা সফর নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোভা জানান, সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক’ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।
রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ১৬ ডিসেম্বর যে আমরা বিজয় দিবস পালন করছি তার প্রেক্ষাপটেও রাশিয়ার ভূমিকা রয়েছে। ওই সময় জাতিসংঘে তারা যদি ভেটো না দিত ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর আত্মসমর্পন হয় না। সৌভিয়েত থেকে রাশিয়া হলেও তাদের চরিত্র একই রয়ে গেছে। ল্যাভরভকে ওই প্রেক্ষিতে আমরা স্বাগত জানাব, সম্মান দেব।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘের ভোটাভুটিতে আমরা একবার নিরপেক্ষ ছিলাম, আরেকবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলাম। আমাদের কথা হচ্ছে, ইউক্রেন জাতিসংঘের সদস্য। ইউক্রেন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।
প্রসঙ্গত, গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা ছিল রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার ঢাকা সফর বাতিল করে মস্কো।
খুলনা গেজেট/এইচ