বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্র, অভিনেতা, নাট্যকার ও লেখক আবুল হায়াত। দুই বছর পর যখন আবরার হত্যার বিচারের রায় হয়, তখন তিনি ছিলেন একটি নাটকের শুটিংয়ে।
দ্রুততার সঙ্গে বিচার হওয়ার ব্যাপারটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আবুল হায়াত। তিনি বললেন, ‘অপরাধীর শাস্তি হলে অন্য অপরাধীরা সাবধান হবে। এরপর কোনো অপরাধ করার আগে দশবার চিন্তা করবে। যখন দেখে যে বিচার হয় না, তখন অপরাধীদের সাহস বেড়ে যায়।’
দুই বছর আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। তা আমলে নিয়ে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
আজ বুধবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের পড়া রায় থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
আবুল হায়াত বলেন, ‘অন্যায়ের বিচার তো করতেই হবে, এটা অবধারিত। অন্যায়ের বিচার না করলে অন্যায় বেড়ে যায়, এটা আমরা জানি। সে হিসেবে বলব, দ্রুততার সঙ্গে রায় হয়েছে, যা পজিটিভ সাইড।’
কথায় কথায় আবুল হায়াত খারাপ লাগার কথাও জানালেন। তিনি বললেন, ‘খারাপ লাগছে এই ভেবে যে আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একটা পরিবারের আশা-ভরসা, স্বপ্ন—সব ধুয়েমুছে চলে গেছে। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও ২৫ জনের জীবন, তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে গেল। এটা সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু জানতে চাই, এর জন্য দায়ী কারা? তাদের তো কোনো বিচার হলো না। কারা তাদের উদ্বুদ্ধ করেছে এ ধরনের অপকর্ম করতে, অপরাধ করতে, সেটার তো কোনো ইনভেস্টিগেশনও হলো না। এই ছেলেগুলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিল, বাবা-মায়ের স্বপ্ন নিয়েই এসেছিল। বাবা-মায়ের দুঃখ–কষ্ট যদি থেকেও থাকে, তারা সেখান থেকে তাদের আলো দেখাবে, এমন স্বপ্ন নিয়েই এসেছিল। তারা তো ক্রিমিনাল হিসেবে কেউ আসে নাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাহলে তাদের ক্রিমিনাল বানাল কে? তাঁদের উদ্বুদ্ধ করল কে বা কারা এই ধরনের একটা নিকৃষ্টতম কাজ করতে, বীভৎসতম কাজ করতে। এসব প্রশ্নগুলো থেকে যাচ্ছে আরকি।’
আবুল হায়াত বললেন, ‘তারা কারা, কোনো দলের লোক, এটা আমি জানি না, জানতে চাইও না। কথা হচ্ছে যে এটা যদি ইনভেস্টিগেট করা হতো, কোথাকার লোক, কার কাছ থেকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ পেয়েছে, তাহলে আমরা যথাযথভাবে বিষয়টা জানতে পারতাম। আমি বলতে চাই, শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা সন্তানতুল্য। সেই সম্পর্ক যখন ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে না থাকবে, তত দিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি কোনো দিন ভালো হবে না। এখানে শিক্ষার্থীকে শাসনও করতে হবে, ভালোও বাসতে হবে। ওদের স্নেহও দিতে হবে—দিয়েই তাঁদের বোঝাতে হবে, তোমরা এখানে এসেছ বাবা-মায়ের স্বপ্ন নিয়ে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে এসেছ, লেখাপড়াটাই তোমাদের এখানে মুখ্য ব্যাপার। কে কোন দল করল, অন্য দল করলে তাকে রুমে ঢুকতে দেওয়া যাবে না, পেটাতে হবে, বের করে দিতে হবে—এসব থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে হবে। এ ধরনের ভাবনাচিন্তা কেনই–বা আসবে ছাত্রদের মধ্যে, যাদের মূল চিন্তাটাই হচ্ছে পড়াশোনা করা।’
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, অভিনেতা, নাট্যকার ও লেখক আবুল হায়াত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘রাজনীতি থাকলে ভালো হবে, না রাজনীতি ছাড়া ভালো চলবে, এটা চট করে বলা কঠিন। তবে আমরা যে পরিবেশে লেখাপড়া করেছি, বড় হয়েছি, সেখানে রাজনীতি দরকার হয়নি। আমরা আমাদের সমস্যার কথা উপাচার্যকে গিয়ে বলতে পেরেছি। এখন ইউকসু নেই। তার ওপর ছাত্ররাজনীতির খারাপ প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া সেখানে উপাচার্য, প্রভোস্ট, শিক্ষক, ছাত্র—সবার মধ্যেই দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা ভালো নেই, যা ফেরাতে হবে যেকোনো মূল্যে।’