আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বিএনপির সঙ্গে সমাঝোতার সুযোগ আছে কি-না। তাদের দাবি অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের বিষয় অবস্থান কি ? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাফ জানিয়েছেন, সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। আর জাতীয় পার্টি নেতারা বলেছেন, পরিস্থিতি বুঝে তারা সিদ্ধান্ত নিবেন।
আ.লীগের সঙ্গে বৈঠক
নির্বাচন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলকে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। সোমবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে প্রায় তিন ঘণ্টা রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকের পর এ কথা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুপুর ১২টায় রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে এ বৈঠক শুরু হয়।
বৈঠক শেষে ওবায়দুল কাদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। তারা পরিস্থিতি জানতে চেয়েছে, আমাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ এবং বাস্তব অবস্থা, কোনো ভায়োলেন্সের আশঙ্কা আছে কি না এসব বিষয় তারা পর্যবেক্ষণ করছেন।
প্রতিনিধি দল কোনো প্রস্তাব দিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা কোনো প্রস্তাব দেয়নি, আলোচনায় উঠে এসেছে বিএনপির দাবি। তারা কথায় কথায় বলেছে আপনাদের মধ্যে কী এখনো কোনো কম্প্রোমাইজের পথ খোলা আছে কি না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অ্যাডজাস্টমেন্টের কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না? আমরা বলেছি সেই পথ বিএনপি ব্লক করে রেখেছে।
কাদের বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ, ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র কীভাবে দেখছি এগুলো জানতে চেয়েছে, আমরা বলেছি।
দেশের ৭০ শতাংশ লোক শেখ হাসিনাকে ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে আছে এমন কথা প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছে জানিয়ে কাদের বলেন, বিএনপির দাবির মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেওয়া এগুলো উঠে এসেছে, আমরা বলেছি সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, প্রতিনিধি দল আমাদের বলেছে, তারা কোনো বিষয়ে মধ্যস্ততা করতে আসেননি। আমরাও বলেছি, আমরা একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সেভাবেই কাজ করছি।তিনি বলেন, তাদের কথাবার্তা পজিটিভ মনে হয়েছে। তারা কোনো পক্ষ নিয়ে এসেছে, এমন মনে হয়নি।
বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ওবায়দুল কাদের। এতে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল অবসরপ্রাপ্ত মুহাম্মদ ফারুক খান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ডক্টর শাম্মী আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ডক্টর সেলিম মাহমুদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
বিএনপি জানালো, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়
রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছে ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল।পূর্ব নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, সোমবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ বৈঠক শুরু হয়। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলটির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
মার্কিন পর্যবেক্ষক দলকে বিএনপির পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে সম্ভব নয়। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায় নির্বাচনে যাবে না বিএনপি।
বৈঠক শেষে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক উইংয়ের প্রধান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
‘আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে বলে আসছি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত দুই-তিনটি নির্বাচনে তারা বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। আজকে যাদের বয়স ৩০-৩২ বছর হয়েছে তারা বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেনি। অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে,’ বলেন আমির খসরু।
প্রশাসন ও বিচারবিভাগ দলীয় করণ করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এখন নিপীড়ন-নির্যাতনসহ ভোট চুরির প্রকল্প অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে। তারা ভোট চুরির প্রকল্পকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। একেবারে বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, লুটেরা ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ তারা একটা প্রজেক্টের মাধ্যমে আবারও তারা বাংলাদেশের মানুষের ভোট চুরি করার অভিপ্রায়ে কাজ করে যাচ্ছে।
‘এখান থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের যে একদফা দাবি; সরকার বলা ভুল হবে—এই রেজিমের পদত্যাগ করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন হতে হবে। সংসদ বাতিল করতে হবে। নির্বাচন কমিশন বাতিল করে সবার মতমতের ভিত্তিতে আরেকটি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে,’ বলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষকরা কী বলেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তারা গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক মানের, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কথা বলছে। এটার সঙ্গে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অথবা নিরপেক্ষ সরকারের কোনো ব্যবধান নেই। শেখ হাসিনার অধীনের নির্বাচন হলে যেটা তারা বলছে, এটা হবে না। এগুলো হবে না বলেই তারা কথাগুলো বলছে। তারা তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার-নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলতে পারে না! এই দাবি উঠতে হবে বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে। তারা যে কথাগুলো বলছে; এই দাবির সঙ্গে কোনো তফাৎ নেই।
বিএনপির সাত সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক উইংয়ের প্রধান ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।
অন্যদিকে মার্কিন পর্যবেক্ষক দলে রয়েছেন রিক ইনডারফার্ত, মারিয়া চিন আব্দুল্লা, মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেস সাক্স স্পাইকারম্যান, আকাশ কুল্লুরি, বোনি গ্লিক, জামিল জাফের, জো কাও প্রমুখ।
জাতীয় পার্টি পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেবে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা যায়- তা জানাতে চেয়েছে বাংলাদেশ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে বৈঠকে তারা এ বিষয়ে দলটির মতামত জানতে চায়।
বৈঠক শেষে জি এম কাদের সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের যোগ দেওয়া বিষয়ে সরকার থেকে প্রস্তাব পেলে বিবেচনা করবে জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে অংশ নেব না- এমন কথা কখনও বলিনি। জাতীয় পার্টি পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেবে। নির্বাচনের বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হলেও সুনির্দিষ্ট হয়নি বলে জানান তিনি।
নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিত যাচাইয়ে বাংলাদেশে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ সদস্যের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। দেশটির সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে এই প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করছে।
পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে জি এম কাদের বলেন, নির্বাচন নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা আছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলন করলে সহিংসতা হতে পারে। অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। অংশগ্রহণমূলক না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো কি-না, তা বোঝা যায় না।
জি এম কাদের জানান, নির্বাচনে কোন কোন ক্ষেত্রে অনিয়ম হয় এবং তা কীভাবে রোধ করা যায় সে বিষয়েও জাতীয় পার্টির মতামত জানতে চান এনডিআই এবং আইআরআই প্রতিনিধিরা। অতীতে কখন কীভাবে নির্বাচন হয়েছে তাও জানতে চান তারা।
রানা মো. সোহেল বলেন, এসব জিজ্ঞাসার সুনির্দিষ্ট জবাব দিয়েছে জাতীয় পার্টি। মার্কিন প্রতিনিধিরা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেনি। তারা স্পষ্ট করে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তাদের ভূমিকা থাকবে না। দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সুপারিশ করবেন।
বৈঠকে আরও অংশ নেন জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাসরুর মওলা এবং ভাইস চেয়ারম্যান আহসান আদেলুর রহমান এমপি।
খুলনা গেজেট/এইচ