খুলনা, বাংলাদেশ | ২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গ্রেপ্তার

ঢাকায় ২৪৩ মামলা, একটিতেও নেই গুলিতে শিক্ষার্থী নিহতের তথ্য

গেজেট ডেস্ক

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার পর বিভিন্ন মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। রাজধানীতে দায়ের করা অনেক মামলায় বিএনপির অধিকাংশ শীর্ষ নেতার নাম রয়েছে। পাশাপাশি শত শত অজ্ঞাত ব্যক্তিকে মামলার আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েকটি মামলায় শিক্ষার্থীকেও করা হয়েছে আসামি।

এদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার কথা কোনো মামলায় স্পষ্ট বলা হয়নি। এমনকি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত হলেও মামলার এজাহারে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়। উল্টো আন্দোলনকারীর ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেলের নিক্ষেপে সাঈদ মারা গেছেন বলে মামলায় দাবি করা হয়েছে। বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া অন্তত ৭০ মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য মিলেছে।

এজাহার বিশ্লেষণ করে আরও জানা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, জনগণ ও সরকারি সম্পদ রক্ষা করতে চায়নিজ রাইফেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে পুলিশ। অনেক মামলার এজাহারে সাউন্ড গ্রেনেড, ফাঁকা গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের কথা বলা হয়। এসব মামলার বাদী পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নানা কর্মসূচি ঘিরে গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় আরও ১৪ মামলা হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ২৪৩। আর সারাদেশে মামলা হয়েছে অন্তত ৬০০। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১০ সহস্রাধিক মানুষকে। স্বজন ও বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র বলছে, আন্দোলন ও পরে সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ২০৮ জন। তবে সরকার এ পর্যন্ত ১৫০ জন নিহত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যদিও শনিবার আন্দোলনকারীরা ২৬৬ জন নিহতের তালিকা প্রকাশ করে। গতকাল রাতে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজধানীতে প্রাণহানির ঘটনায় বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা জানাতে পারেননি তিনি।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা এখন রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা হবে পক্ষপাতমূলক। সরকার যাদের বিরোধী দল মনে করে, এটি তাদের শায়েস্তা করার একটি ব্যবস্থা। এ জন্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে বেছে বেছে মামলা নেওয়া। সীমিত গণতন্ত্রের দেশে জবাবদিহি থাকে না। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের মর্জি-মাফিক কাজ করার সুযোগ পায়। এ ঘটনায়ও পুলিশ খেয়ালখুশিমতো মামলা নিচ্ছে, নিচ্ছেও না।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘এটি আমাদের দুর্ভাগ্য, যে কোনো ঘটনা ঘটলেই রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা হয়। এজাহারগুলো দেখলেই মনে হয়, বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর নাম আগের মামলা থেকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য মামলা করা থেকে শুরু করে তদন্ত কাঠামো ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।’

এদিকে, অতিরিক্ত আইজিপি আনোয়ার হোসেন বলেন, মামলা-গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও কথোপকথন বিশ্লেষণ করেই জড়িতদের শনাক্ত করা হচ্ছে। সহিংসতায় যারা জড়িত, তারা বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য দলের নেতাকর্মী হলে পুলিশের কিছু করার নেই।

নিহতের স্বজনরা যা বলছেন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থী জিহাদ হোসেন, ফুটপাতের দোকানি মো. শাহজাহান, নাজমুল কাজী, রাব্বি আলম পাভেল ও মিষ্টি দোকানের কারিগর মো. শাকিলের পরিবার বলেছে, মামলা করতে আগ্রহী নন তারা। আর একটি পরিবার শিগগিরই মামলা করবে। ক্ষতিগ্রস্তদের ভাষ্য, অধিকাংশ স্থানে আন্দোলনকারীর ওপর গুলি করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে অনেকে মারা গেছেন। আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন কয়েকশ।

মামলার এজাহারে যা আছে

২১ জুলাই শেরেবাংলা নগর থানায় শিক্ষার্থীদের আসামি করে মামলা করেন এসআই আখতারুজ্জামান। মামলায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌহিদ আহমেদ, আহমেদুল কবির, সৌরভ, শাহরিয়ার, মুজাহিদুল ইসলাম, আলতাফ, সেলিম রেজাসহ ২০ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, ২১ জুলাই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে রাস্তা অবরোধ করা হয়। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।

বিটিভির ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজা আক্তার গত ১৯ জুলাই রামপুরা থানায় মামলা করেন। এজাহারে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, নিপুণ রায় চৌধুরী, এম এ সালাম, কাজী সায়েদুল আলম, মিয়া গোলাম পরওয়ার, আমিনুল হক, মাহমুদুস সালেহীনসহ তিন থেকে চার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। পুলিশ এজাহারে উল্লেখ করে, ১৭ জুলাই বিটিভির চারটি গেট ভেঙে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে।

এদিকে, এসআই ফাহাদ হোসেন বাদী হয়ে ২১ জুলাই মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার এজাহারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মো. আবদুস সালামসহ ৫৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত আরও ৭০০ থেকে ৭৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, মোহাম্মদপুরে আল্লাহকরিম মসজিদ, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডের পশ্চিম মাথা ও টাউন হল এলাকায় জড়ো হয়ে আসামিরা ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে।

মোহাম্মদপুর থানার এসআই মধুসূদন মজুমদারের করা একটি মামলার এজাহারে ৫৩ জন এজাহারনামীয় ছাড়াও অজ্ঞাত ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, ১৯ জুলাই সকালে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরকর্মীর সমর্থকরা লাঠিসোটা, লোহার রড, ইটপাটকেলসহ দেশি বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে মোহাম্মদপুরের আল্লাহকরিম মসজিদ থেকে বেড়িবাঁধ তিন রাস্তা মোড় পর্যন্ত দখল করে সরকারবিরোধী স্লোগান দেয় এবং বিক্ষোভ-ভাঙচুর চালায়। পুলিশ তাদের সরে যেতে অনুরোধ করলে তারা হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ে। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেটের পাশাপাশি চায়নিজ রাইফেলের গুলি চালায়।

এই থানায় পুলিশ বাদীর কয়েকটি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আসামিদের হাতে লাঠিসোটা, লোহার রড, ইটপাটকেলসহ দেশি অস্ত্রের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ বা ভুক্তভোগীর করা এজাহারেও কিছু অংশে অভিন্ন কথা রয়েছে। ২১ জুলাই মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন। বছিলায় তাঁর ডায়াগনস্টিক ব্যবসা রয়েছে। এ এজাহারেও বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

এজাহারেও বলা হয়েছে, কোটাবিরোধী বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের লোকজন এবং কতিপয় রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাত বহু লোক দেশি বিভিন্ন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়। লুটপাটসহ মানুষকে মারধর করে। আসামিরা ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় তাঁর প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে বলে এজাহারে উল্লেখ করেন মনোয়ার হোসেন।

হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা, নাশকতা ও ভাঙচুরের অভিযোগে ১৯ জুলাই উত্তরা পূর্ব থানার এসআই পলাশ চন্দ্র সাহা বাদী হয়ে মামলা করেন। এতে ৩৬ জনের নাম উল্লেখ করে আড়াই হাজার জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীসহ দুষ্কৃতকারীদের আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ১৮ জুলাই থানা ভবনের সামনে জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মী ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া উত্তরা পূর্ব থানার প্রায় সব মামলাতেই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!