মূল্য নির্ধারণ কাঠামো সংস্কার হলে জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা পর্যন্ত কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাজারভিত্তিক জ্বালানির মূল্য: সরকারের নেতৃত্বাধীন উদ্যোগ এবং সম্ভাব্য সংশোধন’ শীর্ষক ডায়ালগে এ তথ্য জানায় গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী ও প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট ফয়সাল কাইয়ুম। প্রবন্ধে মাশিয়াত প্রিয়তী বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কোন আইন বা মডেলে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে, তা স্পষ্ট নয়। দাম নিয়ে ভোক্তারা কখনও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ২০১৫ সাল থেকে বিপিসি ভর্তুকি পায় না। কারণ তারা মুনাফা করে এবং ক্ষতি সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে।
সিপিডি মনে করে, জ্বালানি তেলের দাম গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা দরকার। পাশাপাশি মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্য বাড়লে তা সমন্বয় করা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্য, বাজারভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মূল্য নির্ধারণ করা হলে ডিজেলের দাম লিটারে ১০ টাকা ৫০ পয়সা, কেরোসিন ৮ টাকা ১০ পয়সা, পেট্রোল ১১ টাকা ৩২ পয়সা ও ফার্নেস অয়েলের দাম শূন্য দশমিক ৭১ টাকা কমানো সম্ভব।
অনুষ্ঠানে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তেলের দাম নিয়ে আলোচনা আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। তারা জ্বালানির দাম নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে করত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কোনো স্বার্থ নেই। এ কারণে তেলের দাম নির্ধারণে জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করা উচিত। খাদ্যের মতো জ্বালানি নিশ্চিত করাও সরকারের মৌলিক দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিপিসি জ্বালানি থেকে ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। সরকার একসঙ্গে মুনাফা ও ট্যাক্স নেয়। সরকারের কাজ এটি হতে পারে না।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে মিটিং হতো সিঙ্গাপুর-দুবাইয়ে। এ মিটিংয়ের নামে যে বাড়তি খরচ হতো, পরে তা জ্বালানির দাম নির্ধারণের ওপর চাপানো হয়েছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমাতে হলে চুরি কমাতে হবে। সিস্টেম লসের পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য তেল বিক্রির কার্যক্রমে অটোমেশনের বিকল্প নেই। আমাদের মজুত করার ক্ষমতা কম, ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে মজুতের সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ চলছে। এতে খরচ কমার পাশাপাশি দামও কমবে।
ডায়ালগে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসির হাতে ছেড়ে দেওয়া ইস্যুতে সরকার দ্বিধায় রয়েছে। যে কোনো সময় যে কোনো কিছু (হঠাৎ দাম বৃদ্ধি) হতে পারে, তখন ভোক্তারা বহন করতে পারবে কিনা ভেবে দেখতে হবে। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে আমি উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁকে জানিয়েছি, তেমন পরিস্থিতি এলে সরকার বিইআরসির মাধ্যমেও ভর্তুকি দিতে পারবে। বিইআরসি শিগগির তেলের দাম নিয়ে কাজ করবে। বিপিসি যে তালিকা করেছে, তা চূড়ান্ত নয়। অবশ্যই অনেক বিষয় উঠে আসবে। ভোক্তার মতামতও নেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তৌহিদ মওলা বলেন, বাজারভিত্তিক মূল্য পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যতই বাড়ুক, দেশে তা যেন ১০ শতাংশের ওপরে করা না হয়। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ কমানোর পরামর্শ দেন তিনি। দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে কাজের ক্ষেত্রে মানুষ ডিজেল বেশি ব্যবহার করে। এ কারণে ডিজেলের দাম পুনর্বিবেচনা করার পরামর্শ দেন তৌহিদ মওলা।
ডায়ালগে সিপিডি জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, মূল্য ঠিক করা ও বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম বিইআরসির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। গণশুনানির মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে বিইআরসি একটি রেগুলেটরি ড্রাফট জমা দিয়েছিল। সেটি অনুমোদন করা হলে আইনি পথে মূল্য নির্ধারণের বিষয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে সিপিডির মত।
অনুষ্ঠানে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সব খাতে সংস্কার চলছে। জ্বালানি খাতেও এর হাওয়া লাগছে। ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনা করে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে। বিপিসি তার মুনাফা সমন্বয় করলে ভোক্তাস্বার্থ প্রাধান্য পাবে। বিদ্যুতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
খুলনা গেহজট/কেডি