নিজেকে ভালোবাসেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে আছেন কিনা আমার জানা নেই। তবুও সিগারেটের গায়ে লেখা ‘ধুমপানে বিষপান’ এই বাক্যটি শতবার পড়েও আমরা কেউ কেউ আলোমাখা জীবনে বিষবাস্প ছড়িয়ে দিচ্ছি অবলিলায়।
চিকিৎসকদের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিদিন একটি মানুষের ধুমপানের জন্য ১৪ মিনিট করে আয়ু কমতে থাকে। ২০১৫ সালের মে মাসে নারী-শিশুসহ সব অধুমপায়িকে পরোক্ষ ধুমপানের শিকার থেকে রক্ষায় কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের ১৩ লাখ মানুষ কোন না কোনভাবে তামাক সেবন করছে, কিন্তু পরোক্ষভাবে ক্ষতি করছে ১৫ লাখ মানুষের। দেশে প্রকাশ্যে ধুমপানের জরিমানা ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। তবে ক’জন জানে এটা? আর আইন প্রয়োগকারিরা কেবল আইন পাস করেই খালাস। বাস্তবে তা প্রয়োগের লেশমাত্র নেই।
সন্ধ্যায় রাস্তায় হাটতে বের হলে দেখা যায়- একটা সিগারেট তিনচারজন বন্ধু মিলে টানছে। যাদের বয়স ১২/১৩ বছরের বেশি না। এটা আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ।
স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চাদের কাছে সিগারেট বিক্রি করার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।
আমার বাসার ঠিক সামনে ১০/১২ বছরের একটা ছেলেকে সিগারেট ফুকতে দেখে আমি একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটি নামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত থাকায় আমার চোখ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। কেন সিগারেট খাচ্ছে জানতে চাইলে উত্তরে কি বলল জানেন? ‘আমার বাবার টাকায় আমি খাচ্ছি আপনার কি?’ কথাটা শুনে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।
এরপর কতশত বার যে এমন মন খারাপ করা দৃশ্য দেখেছি তার ঠিক নেই। আসলে কান্না ছাড়া আমার করার কিছু কি আছে? যাদের করার কথা তারা চোখে কালো কাপড় বেধে আছে। ভুটান পেরেছে ধুমপানমুক্ত দেশ গড়তে। আমরাও কি পারি না?
বিয়ের আগে বর মশাই এর সাথে একবারই ফোনে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আমার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল উনি ধূমপান করেন কিনা।
উনি ‘না’ বলাতে আমার বুকের থেকে একটা পাথর নেমে গিয়েছিল। আমার কেবলই মনে হতো যিনি ধূমপান করেন তিনি এ পৃথিবীর সবথেকে বোকা ও হৃদয়হীন মানুষ। কারণ, যে মানুষ নিজের জীবনকে ভালোবাসে না সে অন্য কাউকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেও পারেনা। হৃদয়টাতো একটু একটু করে পুড়তে থাকে।
আমাদের দেশের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ অতিআধুনিক নেশাজাতীয় দ্রব্য আমদানি ও গ্রহণে একেবারে সিদ্ধহস্ত। তবে সিগারেটকেই প্রতিক করে লিখলাম। বোধকরি, নেশার হাতেখড়ি এটা দিয়েই শুরু হয়।
আমাদের দেশে মেয়ে ধূমপায়ীদের দম্ভ দেখিয়ে ধূমপান করতে খুব একটা দেখা যায় না। তাই ছেলেদের কথা বলা।
আপনি বন্ধুদের আড্ডায় সিগারেটের প্রথম সুখ টান দিলেন, খুব একটা সুখকর কিছু অনুভব করলেন কি?
ভালো না লাগা সত্ত্বেও পরের দিন আবারও খেলেন। কারণ এটা না খেলে স্মার্ট হওয়া যায় না। পুরুষ থেকে মহাপুরুষের পথে অগ্রসর হওয়ার এটা নাকি প্রথম ধাপ।
ছাত্রজীবনে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে-
“আমার রাত জাগা তারা তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি আমি পাইনা খুঁজে তোমায় আমার একলা লাগে ভারি।”
গানের কথাগুলোর মতো কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে একলা লাগা ঘুচাতে আপনি ধূমপানকে সঙ্গি মনে করলেন, কিন্তু একবারও ভেবে দেখলেন কি বাবা-মা-ভাই-বোন যারা একটু একটু করে আপনার ভবিষ্যৎ এর সিঁড়ি তৈরি করার কারিগর হয়েছেন তাদের কথা নিমেষে ভুলে গিয়ে তাদেরকেও একলা করার পথে আপনি পা বাড়ালেন। কারণ ধুমপান মানে বিষপান। মা-বাবা আপনার জীবন গড়ে দেওয়ার চিন্তা সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে এই চিন্তাই করছেন আমার সন্তান নেশাগ্রস্থদের দলভুক্ত যে হলো এর থেকে মুক্তি পাবেতো? বাঁচবেতো?
সংসারের নানান জটিলতায় বিরক্ত হয়ে, ব্যবসায় লস খেয়ে, উচ্চকঙ্খার চুড়া ছুতে না পেরে দুঃচিন্তায় জর্জরিত হয়ে চিন্তা থেকে পালানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হিসাবে বেছে নিলেন ধুমপান নামক এই অমৃত।
টানলেন বুক ভরে। আপনি নুন্যতম ভদ্রতাটুকুও ভুলে মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান প্রতিবেশী, অফিস সহকর্মী সকলের সম্মুখে অবলিলায় সিগারেট ফুকছেন। নিজের টেনশনকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে গিয়ে আপনি আপনজনদের ঠিক কতটা চিন্তত করে রেখেছেন, পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছেন একটু ভাববার অবকাশ হবে কি আপনার?
যে সন্তান আপনার কলিজার টুকরা, যে স্ত্রীকে আপনি প্রতিদিন ভালবাসার কথা বলছেন তাদের শারিরীক, মানসিক অসুবিধার কথা জেনেও চার দেয়ালের মধ্যে বন্ধঘরে সিগারেটের ধোয়ায় ঘর ভরিয়ে তুলছেন। আপনার সন্তানকে কেউ সামান্যতম আঘাত করলে, ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আপনি পুলিশের দারস্থ হন। অপরাধীর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করেই তবে আপনি শান্ত হন। তাহলে আপনার শাস্তিটা কি মাপের হওয়া উচিৎ বলবেন কি? আপনার স্ত্রীর প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিৎ আপনাকে গারদে ভরা কারন আপনি আপনার স্ত্রী ও সন্তানের সবথেকে নিকটবর্তী শত্রু। আপনি তো ধোয়াই মোড়া ধরনী থেকে বিদায় নিবেন আপনার ডাক আসলেই, কিন্তু সন্তান এর জন্য এমন একটা পৃথিবী রেখে যেতে ইচ্ছা করে না-যেখানে কৃষ্ণচুড়ার আলোঝরানো পথে ওরা হাটবে, সবুজ ঘাসে পা রেখে ঝলমলে সকাল দেখবে। মাথাটা ঠান্ডা করে একটু চোখ বন্ধ করুন। ভাবুন, মনটাকে প্রশ্ন করুন জীবন কি সত্যিই আপনাকে এভাবে বঞ্চিত করেছে যে আপনি জীবন থেকে পালিয়ে যাবেন?
আপনি যে দুটি হাত, দুটো পা নিয়ে সুস্থ শরীরে পৃথিবীর মুখ দেখলেন। জন্মের পর মা-বাবা সহ একটা পরিবার পেলেন এটা কি কম ভাগ্যের? জন্মের পর কেউ আপনাকে রাস্তার ধারে অথবা ড্রেনে ফেলে যায়নি, আপনাকে নাম পরিচয়হীনদের দলে নাম লেখাতে হয়নি, বেঁচে থাকার জন্য সমস্ত মৌলিক অধিকারের আয়োজন পরিবার, সমাজ আপনার জন্য নিশ্চিত করছে এটা কি আপনার খুব সামান্য মনে হচ্ছে?
বস্তির অসহায় লোকগুলোর মত সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের বন্ধ দরজার সামনে লম্বা লাইন দিতে হয় না। গাদাগাদি করে এক ঘরে অনেকের সাথে ঘুমাতে হচ্ছে না এটা কি কম সম্মানের?
আপনি কি কখনো সোমালিয়া, ইরাক, আফগানিস্থান এসব দেশের মানুষগুলোর কথা ভেবে দেখেছেন? আপনি সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া আদায় করবেন না?
না খেয়ে থাকার যন্ত্রনা সহ্য করতে হচ্ছে না বলে, মাথার উপর অবিরাম বোমা পড়ছে না বলে। উত্তর কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মত এত কঠিন দেশনেতার অধিনে জীবন কাটাতে হচ্ছে না বলে। আপনি ঠিক কতটা কষ্টে আছেন?
লেখক : শিক্ষক, ইসলামাবাদ কলেজিয়েট স্কুল, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম