বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এ রূপ নিয়েছে। ক্রমশ এটি শক্তি বাড়িয়ে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। সিত্রাং এর প্রভাবে সোমবার (২৪ অক্টোবর) ভোর রাত ৩টার দিক থেকে সাতক্ষীরায় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়া। ক্রমশ বাতাসের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপকূলীয় এলাকাজুড়ে জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে উপকূলবাসীর মনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
এদিকে আইলা, সিডর ও আম্পানের পরে আবারও ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর আঘাতের খবরে জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কায় রীতিমত আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সাতক্ষীরার উপকূলের মানুষ। আম্পানের ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে। ষাটের দশকের বেড়িবাঁধের ভঙ্গুর দশায় আবারও প্লাবনের আশংকায় রয়েছেন তারা। উপকূলীয় অ লে ভাল বেড়িবাঁধ নেই, নেই তেমন কোন সাইক্লোন সেন্টার। এই অবস্থায় ফের ঘূর্নিঝড় সিত্রাং এর আঘাতের পদধ্বনি উপকূলীয়বাসির উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঘূর্নিঝড় সিত্রাং মোকাবেলায় নেয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
অপরদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও শীট দিয়ে শ্যামনগরের দুর্গাবাটি এলাকার ভাঙন কবলিত বাঁধের প্রায় ১৫০ মিটার ঢেকে দেয়া হয়েছে। তবে, শ্যামনগরের দাতিনাখালী, পশ্চিম কৈখালীসহ জেলেখালী, নেবুবুনিয়া, পদ্মপুকুর ও গাবুরার অন্তত চারটি পয়েন্টের বাঁধ অত্যান্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাউনিয়া, নাকনা, রুয়েরবিল, চুইবাড়িয়া, দৃষ্টিনন্দন ক্লোজার, হরিষখালী ও কামারখালী, আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, নয়াখালী, কাকবসিয়ার দু’টি পয়েন্ট, মনিপুর, দক্ষিন একসরা ও নাংলা, শ্রীউলা ইউনিয়নের কোলা ও হাজরাখালী, খাজরা ইউনিয়নের গদাইপুর ও খাজরা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, বড়দল ইউনিয়নের কেয়ারগাতি এবং আশাশুনি সদরের বেশ কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভাঙনকবলিত এসব এলাকা গুলো কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে এসব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঝুকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে অথবা ছাপিয়ে এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সোমবার ভোর রাত ৩টার দিক থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়া। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝড়ের সাথে একই সময়ে জোয়ারের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাইবো’র বেড়িবাঁধ ভেঙে ও ছাপিয়ে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশের আশংকায় উৎকণ্ঠায় রয়েছে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারি লোকজন। ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় ইতিমধ্যে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে শুরু করেছেন। অনেকে সরিয়ে নিচ্ছেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
শ্যামনগরের পোড়াকাটলা গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষীত মন্ডল জানান, তাদের বাড়ির সম্মুখভাগে দুর্গাবাটি এলাকার বেড়িবাঁধ খুবই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। কয়েক মাস আগে কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ সংস্কার সত্তে¡ও চর দেবে যেয়ে স¤প্রতি সেখানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে জোয়ারের সাথে যদি ঝড় মারাত্মক আকার ধারণ করে তবে সমগ্র এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে।
নৈকাটি গ্রামের আনিছুর রহমান জানান, দীর্ঘদিন ধরে তাদের এলাকার বাঁধ জীর্ণশীর্ণ ও সরু আইলের আকৃতি নিয়ে আছে। সম্প্রতি ভাঙন কবলিত অংশের পাশে কিছু বালুভর্তি জিও ব্যাগ দেয়া হলেও সেখানকার পরি¯ি’তি অত্যন্ত ভয়াবহ। সাগরে নি¤œচাপের কারণে তাদের এলাকার শতাধিক পরিবার ভাঙন আতংকে রয়েছে।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম জানান, চারপাশে নদীবেষ্ঠিত গাবুরাকে ঘিরে থাকা বাঁধ আইলার পর থেকে বেশ নিচু হয়ে আছে। এছাড়া ইয়াস ও আম্পানের পর থেকে বড়গাবুরা, হরিশখালীসহ কয়েকটি অংশের বাঁধও বেশ ঝুঁিকপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও অদ্যাবধি কাজ শুরু হয়নি। এমতাবস্থায় ইউনিয়নের ৪০ হাজারের বেশী মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-২এর সেকশন অফিসার মাসুদ রানা জানান, পাউবো’র প্রধান প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রোববার সকাল থেকে শ্যামনগরের ভাঙন কবলিত নেবুবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা পরির্দশন করেছেন। পাউবোর পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে জিও ব্যাগ স্থাপনসহ জিও শীট বিছানো এবং মাটি দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে। সোমবারও ঝুকির্পর্ণ এসব স্থানে কাজ অব্যহত রয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ শাহীনুল ইসলাম জানান, সাইক্লোন শেল্টার ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আক্তার হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সিত্রাং আঘাত আনতে পারে সাতক্ষীরা উপকূলে। শ্যামনগর উপজেলায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি। এছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ অন্য পাকা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৮০টি। এসব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। তবে এ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তাই পুরাপুরি সামাল দিতে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডেও দু’টি বিভাগের আওতায় ৭৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। যার মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের ৩৫টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ইতিমধ্যে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া বাকি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, ঘূর্ণিঝড়টি আগামী ২৫ অক্টোবর মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানতে পারে। সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ¡াস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। ইতিমধ্যে উপকূলীয় উপজেলা প্রশাসনকে দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রিম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগের ৭৮০ কিলোমিটার বেড়ীবাধ রয়েছে। এর মদ্যে ৮০ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১০ টি পয়েন্টে ঝুকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে। বেড়ীবাধ ভাঙ্গন এড়াতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ২০ হাজার জিও ব্যাগ মজুদ রাখা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আরও জানান, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলায় ১০৮ টি এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১০৩ টি আশ্রয় কেন্দ্রসহ ৪৬ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুুত রাখা হয়েছে। এছাড়া দূর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ঔষধ, সুপেয় পানিসহ প্রয়োজনীয় সহ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। প্রস্তুুত রয়েছে ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া দুর্যোগকালীন জরুরী সাড়াদানের জন্য জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ।