অবকাঠামো চিকিৎসা সামগ্রী থাকলেও বাগেরহাটের একমাত্র মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় কাঙ্খিত সেবা থেকে বন্চিত হচ্ছ জনসাধারণ। প্রতিষ্ঠানটিতে এখন পর্যন্ত শিশু, গাইনি বিশেষজ্ঞ,নার্স ও ফার্মাসিস্টের কোন পদ সৃষ্টি হয়নি।
পর্যাপ্ত নার্স, শিশু ও গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় নবজাতক ও প্রসূতি মায়েদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় বলে জানিয়েছেন বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) ডা. আব্দুস সামাদ। বিদ্যমান অর্গানোগ্রাম সংশোধন করে নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে এসব সংকট সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক হাবিবুল হক খান।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ১৯৮১ সালে প্রসূতি মা ও নবজাতকদের সুচিকিৎসা দেওয়ার জন্য বাগেরহাট শহরের আলীয়া মাদরাসা সড়কে বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্র৷ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার ৩৯ বছরেও জেলাবাসীকে কাঙ্খিত সেবা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। জন্মলগ্নের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ২০ শয্যার এই হাসপাতালের জন্য মাত্র ৮টি পদ রয়েছে। পদগুলো হচ্ছে দুইজন চিকিৎসক (মেডিকেল অফিসার-ক্লিনিক এবং মেডিকেল অফিসার-এ্যানস্থেশিয়া), একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, দুইজন সহকারি নার্সিং এ্যাটেন্ডেন্ট, একজন পিয়ন কাম চকিদার, একজন গাড়ি চালক, একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী। এসব পদের মধ্যে পরিকল্পনা পরিদর্শিকার পদ শূন্য রয়েছে। দুইজন চিকিৎসক এবং দুইজন সহকারি নার্সিং এ্যাটেন্ডেন্টও শারীরিকভাবে অসুস্থ্য। অসুস্থ্য থাকার পরেও তারা সেবা দিচ্ছেন রোগীদের।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে থেকে জানা যায়, জেলার একমাত্র মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র হওয়ায় প্রতিদিন শতাধিক শিশু ও প্রসূতি মায়েরা আসেন এই হাসপাতালে। মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি স্বাভাবিক ডেলিভারি হয় এখানে। করোনার মধ্যে গেল মাসেও ২৫টি স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে। ২০২০ সালে স্বাভাবিক ডেলিভারি হয়েছে ৩৭৭টি। তবে চিকিৎসক অসুস্থ্য থাকায় ২০১৮ সালের পর থেকে এখানে সিজার বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে আসা শিশু ও প্রসূতি মায়েদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসকদের। হাসপাতালে জন্ম নেওয়া অসুস্থ্য শিশুদেরকে স্থানান্তর করতে হয় অন্য জায়গায়। প্রত্যন্ত গ্রাম ও দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা প্রসূতি মা ও শিশুরাও পরেন বিপাকে।
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গোপালপুর থেকে আসা হ্যাপি বেগম নামের এক মা বলেন, কয়েকদিন ধরে আমার ছেলের জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকস্ট ছিল। এখানে আসলে চিকিৎসকরা বললেন শিশু বিশেষজ্ঞ নেই, অন্য জায়গায় নিয়ে যান।
বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা থেকে আসা মৌসুমি বেগম নামের একনারী বলেন, প্রসব বেদনা উঠলে ছোটবোনকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিজার না হওয়ায় সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে যদি সিজার না হয় আমরা কোথায় যাব।
এদিকে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এই প্রতিষ্ঠানে গাইনি ও শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিতরা। অর্গানোগ্রাম সংশোধন করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশন, বাগেরহাট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মোশাররফ হোসেন বলেন, একসময় প্রতিষ্ঠানটি ভালই চলত। মানুষ সেবা পেত। কিন্তু বর্তমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। জরুরী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দরিদ্র মা ও শিশুরা। জরুরী ভিত্তিতে অর্গানোগ্রাম সংশোধনসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার (ক্লিনিক) ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা প্রতিদিন অনেক রোগীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এই কেন্দ্রের সেবা কার্যক্রম সচল রাখতে আমরা উপজেলা থেকে চারজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে দুইজন পিয়ন কাম চকিদার এবং দুইজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। এরপরেও বেশি অসুস্থ্য শিশু ও সিজার প্রয়োজন হওয়া রোগীদেরকে স্থানান্তর করতে হয় আমাদের।
বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আসা সকল রোগীদের সেবা দিতে এই কেন্দ্রে অন্তত ৪ জন চিকিৎসক, ৮ জন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা, ওয়ার্ড বয়ম নার্সসহ প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ডা. আব্দুস সামাদ।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক হাবিবুল হক খান বলেন, বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী চিকিৎসকও রয়েছে। অন্যান্য ষ্টাফের চাহিদা পূরণের জন্য অন্য জায়গার লোক দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও সারাদেশে পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা ও পিএসসির মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে সংকট পূরণ হবে। এরবাইরেও বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রকে যুগপযোগী করতে অর্গানোগ্রাম সংশোধণের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় জনবলের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করার আশ্বাস দেন তিনি।
বাগেরহাট মা ও শিশু কল্যান কেন্দ্রের সংকট সমাধানে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার আশ্বাস দেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ আজিজুর রহমান।