গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে জনপ্রশাসনে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফেরেনি। বিগত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত কিছু কর্মকর্তা সচিবালয়ে আসছেন না। একজন সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে সচিব পদে থাকা ১১ জন কর্মকর্তার।
অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা বিক্ষোভে নেমেছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পদোন্নতি দেওয়াও শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদ পর্যন্ত মোট ৩৪০ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
মাঠ প্রশাসনেও একধরনের অস্থিরতা চলছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। এর ফলে মাঠ প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের আন্দোলনের মুখে তিন দিনের ছুটি নিয়ে কর্মস্থল ছেড়েছেন ঝিনাইদহের ডিসি এস এম রফিকুল ইসলাম। গত রোববার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ডিসির দুর্নীতি, দলীয়করণ, ঘুষ-বাণিজ্য ও অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য পাচারের অভিযোগ এনে তাঁর কার্যালয় ঘেরাও করেন। এরপর ডিসি ছুটিতে যেতে বাধ্য হন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিগত সরকারের আস্থাভাজন সব ডিসিকে প্রত্যাহার করা হবে। তাঁদের পরিবর্তে নতুন ডিসি নিয়োগের প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
সচিবালয় ও মাঠপ্রশাসনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সাবেক দুজন জ্যেষ্ঠ আমলার মূল্যায়ন হচ্ছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে, তা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। এই অনিয়মের ফল হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনের সব স্তরে একধরনের অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর গত দুই সপ্তাহে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদ পর্যন্ত মোট ৩৪০ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি-সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন যাঁরা বঞ্চিত ছিলেন, তাঁরা যেমন পদোন্নতি পেয়েছেন, তেমনি যাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাঁরাও পদোন্নতি পেয়েছেন। এ নিয়েও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এক সপ্তাহের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে প্রথমে উপসচিব, এরপর আবার পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়ে গেছেন। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে দুবার পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে ওই কর্মকর্তারা পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। তাঁদের ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা কয়েক বছর আগেই সচিব হয়ে গেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপসচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এখন চাপ দিয়ে পদোন্নতি নেওয়া হচ্ছে। শৃঙ্খলা মানা হচ্ছে না। পদোন্নতিবঞ্চিতরা অন্য কর্মকর্তাদের কক্ষে (যাঁরা এখন অফিসে আসছেন না) বসে থাকেন। এটি জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলা নষ্ট করছে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৪৫ জন কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে প্রথমে উপসচিব, এরপর যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন, তা জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, এখন এক ব্যতিক্রমী ও অস্বাভাবিক সময় চলছে। পদোন্নতির বিষয়টিকে সেভাবেই দেখা উচিত। এর প্রভাব কী হবে, তা এখনই বলা যাবে না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর ৬-৮ আগস্ট দেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার আগেই ৬ আগস্ট বিভিন্ন দপ্তর থেকে ২২ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এসব কর্মকর্তা বিগত সরকারের সময়ে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। তাঁরা সচিবালয়ের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তরে ছিলেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার আগে ওই কর্মকর্তাদের কীভাবে বদলি করা হলো, জানতে চাইলে জনপ্রশাসনসচিব মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতি তাঁর নির্বাহী আদেশে এসব বদলি করেছেন। সচিবালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, ওই কর্মকর্তাদের কারও পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কারও বাড়ি বগুড়ায় কেউবা ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ‘বঞ্চিত’ ১১৭ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় ১৩ আগস্ট। এরপর ১৮ আগস্ট যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয় ২০১ জন কর্মকর্তাকে। তাঁদের মধ্যে অন্তত ৪৫ জন ১৩ আগস্ট একবার পদোন্নতি পেয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার আরও ২২ কর্মকর্তাকে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে গত দুই সপ্তাহে ৩৪০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এসব পদোন্নতির মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এখন অনেকটাই বিএনপি–জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের কাছে চলে গেছে বলে সচিবালয়ের একাধিক সূত্র বলছে। তবে যাঁরা পেশাদার কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত, তাঁদের অনেকে এখন সমস্যায় পড়ছেন। তাঁদের কেউ কেউ পদোন্নতির ক্ষেত্রে আগেও বঞ্চিত হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন।
বিসিএস ২৮তম ব্যাচ (২০১০ সালে এই ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পান) থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৪ আগস্ট। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা বলে তাঁদের এত বছর নিয়োগ দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। অন্যদিকে ৬ থেকে ২০ আগস্ট (গতকাল) পর্যন্ত মোট ২৮ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে।
সরকারি চাকরির বিধিবিধানের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে প্রশাসনে দ্রুত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে। সবাইকে খুশি করতে গেলে লেজেগোবরে হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে রাতারাতি কোনো কিছুর পরিবর্তন সম্ভব নয়।
জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের অনুমোদিত পদ এখন ২১২টি। এখন কর্মরত আছেন ৩৯৬ জন। যুগ্ম সচিবের অনুমোদিত পদ রয়েছে ৫০২টি। এখন কর্মরত ৭৭৪ জন। এ ছাড়া উপসচিব পদে অনুমোদিত পদ যেখানে এক হাজার, সেখানে কর্মরত আছেন ১ হাজার ৬৯৮ জন। সচিব পদে কর্মরত ৮৪ জন।
পদোন্নতি পাওয়া ৫০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ
পদোন্নতির নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৩ আগস্ট যে ১১৭ জন কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া বিসিএস ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা সেকেন্দার হায়াত ঝালকাঠির নলছিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করেন। পরে তাঁর নামে বিভাগীয় মামলা হয়। শাস্তি হিসেবে তিন বছর তাঁর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা হয়। পদোন্নতি পাওয়া আরেক কর্মকর্তা আকবর আলী ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ২০ লাখ টাকার গাছ ৫৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। এ ঘটনায় বিভাগীয় মামলার পর দুই বছরের জন্য তাঁর পদোন্নতি স্থগিত রাখা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিসিএস ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তা আব্দুর রউফ তালুকদার মাদারীপুরে সহকারী কমিশনার থাকাকালে একটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেননি। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ, তথ্য গোপন করার অভিযোগ বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত হয়। এসব কারণে তাঁকেও লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তিনিও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান।
এ বিষয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নানা অভিযোগ তুলেছিল। তিনি এখন গাইবান্ধা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিসিএস ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তা এ এইচ এম আসিফ বিন ইকবাল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) থাকার সময় এক পাথর ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরে বিভাগীয় মামলায় ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় তাঁর বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়। তিনিও এবার পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হন।
এ ছাড়া উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া বিসিএস ২৪তম ব্যাচের পাঁচজন, ২৫তম ব্যাচের ছয়জন, বিসিএস ২৭তম ব্যাচের ছয়জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। পরে বিভাগীয় তদন্তে তাঁদের কারও পদোন্নতি দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়, কাউকে তিরস্কার করা হয়।
জনপ্রশাসনে উপসচিব পদমর্যাদার শতাধিক কর্মকর্তা গতকাল সকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেনের সঙ্গে দেখা করে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগ না দিতে অনুরোধ করেন। তাঁদের মাঠ প্রশাসনে পাঠানো হলে সরকারের সুনাম নষ্ট হবে বলে জানান তাঁরা। গত সরকারের সময়ে যাঁরা বঞ্চিত, সৎ, যোগ্য ও মেধাবী, তাঁদের ডিসি বানানোর অনুরোধ করেন ওই কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/এইচ