ছাগল পালনে দারিদ্র্য বিমোচন করে সংসারে সুদিন এনেছেন সাতক্ষীরার সালমা আক্তার। বদলে ফেলেছেন নিজের ভাগ্য। এলাকার বেকার যুব ও মহিলাদের মধ্যে জ্বেলেছেন আশার আলো।
সালমা আক্তারের বাড়ি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ি ইউনিয়নের বালিথা গ্রামে। তাঁর স্বামীর নাম মুজিবুর রহমান। স্বামীর চাষযোগ্য জমি না থাকায় অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে বিলগুলো মৎস্য ঘের করায় এখন আর ফসল চাষ হয়না।
সালমা আক্তার জানান, ছোট থাকতে একবেলা খাবার জুটলেও অন্য বেলা উপোস থাকতে হতো। এরই মধ্যে স্বপ্ন দেখেন নিজে কিছু করার। ছোটবেলা থেকে ছিলো উদ্যোক্তা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। মাত্র দুটি ছাগল পালনে শুরু করেন স্বপ্ন জয়ের যাত্রা। দেখতে দেখতে ছোটখাটো একটি খামার হয়ে যায় তাঁর। সাতক্ষীরা সদরের ফিংড়ি ইউনিয়নের বালিথা গ্রামে নিজের বাড়িতেই বিশাল ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন সালমা আক্তার। সেখানে দুম্বা, ছাগল ও গাড়ল পালন করেন তিনি।
সালমা আক্তার আরো জানান, ছোটবেলা থেকেই পশুপাখির প্রতি ভালোলাগা থেকেই ছাগল পালনের প্রতি আগ্রহ জন্মায় তার। দারিদ্র্য বিমোচনে ছাগল পালন ভূমিকা রাখে। তাই বিয়ের পরেও স্বামীর বাড়িতে এসে স্বামীকে সাথে নিয়ে বৃহৎ খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। বিদেশি জাতের ছাগল বছরে দুইবার বাচ্চা দেয়। একটি ছাগল সর্বোচ্চ ৫টি বাচ্চা দেয়। ছয় মাস বয়সী ছাগল বিক্রি হয় ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। একটি ছাগল ছয় মাসে খড়, কাঁচা ঘাস, ভুষি খায় প্রায় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার।
সালমা আক্তার জানান, বর্তমানে তার খামারে শতাধিক উন্নত জাতের ছাগল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শিরহি, তোতাপুরি, নাগপুরী বিটল, যমুনা পাড়ি, গুজরি, হরীয়ানাসহ দেশি-বিদেশি উন্নত জাতের ছাগল। যার বাজার মূল্য ২০ হাজার থেকে শুরু করে প্রায় ২লাখ টাকা পর্যন্ত। সালমা আক্তারের খামারে দু’জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যাদের মাসিক আয় দশ হাজার টাকা।
খামারে কর্মরত শ্রমিকরা বলেন, প্রতিদিন তিন বেলা ছাগলের খাবার ও পানি দিতে হয়। এছাড়া ছাগলকে গোসল করানো ঔষধ খাওয়ানো, খড়, কুটা, ভূষি, বিচালি, সবুজ ঘাষ খেতে দিতে হয়। উন্নত জাতের পাঠা ছাগল পালনে সালমা আক্তারের বেশ সুনাম রয়েছে। তার খামারে বাঘা তোতা পাঠা, মেউতি তোতা পাঠা, বিটলসহ উন্নত জাতের পাঠা ছাগল রয়েছে। যার প্রতিটির বাজার মূল্য লক্ষাধিক টাকা। সালমা আক্তারে সাফল্য দেখে প্রতিবেশী নারীরাও ছাগল পালনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সালমা আক্তার তাঁদের ছাগল পালনের পরামর্শ দেন। ধীরে ধীরে সাতক্ষীরা সদরের অনেক বেকার যুবকও সালমা আক্তারের থেকে ছাগল পালনের পরামর্শ নিয়ে ছোট ছোট ছাগলের খামার তৈরি করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে।
দীর্ঘ ৩০ বছর ছাগল পালনের অভিজ্ঞতা নিজের মধ্যে আবদ্ধ না রেখে সালমা আক্তার ছড়িয়ে দিচ্ছেন তার এলাকায়। ভূমিকা রেখে চলেছেন গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছাগল পালনে। বর্তমানে সালমা আক্তারের মাসিক আয় ৭০হাজার থেকে শুরু করে ৯০হাজার টাকা। কিন্তু সালমা আক্তারের কিছু আক্ষেপ রয়েছে।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরা জেলা শহরে তার মতো বড় ছাগলের খামার আর কারো নেই। এরপরেও ৩০ বছরে একটি দিনও জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের কোন প্রাণীর চিকিৎসক খামারটি পরিদর্শন করেননি। খামারের ছাগলের কোন অসুখ হলে চিকিৎসার জন্য গ্রামের যে সকল পশু চিকিৎসক ডাকা হয়। অনেক সময় তাদের ভুল চিকিৎসায় ছাগল মারা যায়। তাই জেলা প্রাণিসম্পদ থেকে উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে এবং জেলার বড় বড় খামারগুলো যদি প্রাণিসম্পদ অফিসের সহায়তা পায়, তাহলে সাতক্ষীরা জেলার বেকার যুবক থেকে শুরু করে হাজারো নারী উদ্যোক্তার ভাগ্য বদলাতে পারে ছাগল পালনে।
স্থানীয় ফিংড়ি ইউপি সদস্য আরশাদ আলী জানান, দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছি—সালমা আক্তার দেশি-বিদেশি ছাগল পালনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। তাঁর দেখাদেখি গ্রামের অনেক নারী ও যুবক ছাগল পালনে বদলে ফেলেছেন নিজেদের ভাগ্য। সালমা আক্তার এখন দারিদ্র্য বিমোচনে এলাকার মডেল। তাঁর মতো উদ্যোক্তা তৈরি হলে বদলে যেতে পারে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা। শুধু দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এসএম মাহবুবুর রহমান জানান, সালমা আক্তারের ছাগলের খামারটির বিষয়ে তিনি যোগদানের পর অতি সম্প্রতি জেনেছেন। বিষয়টি জানার পর তিনি ও তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তাকে খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতার তাগিদ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সালমা আক্তার ছাগল পালনের মাধ্যমে নিজের দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি অনেক নারী ও যুবকের বেকারত্ব দূরীকরণে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করা হবে।
খুলনা গেজেট/এনএম