অজস্র ছাত্র-ছাত্রী, গুণগ্রাহী ও মানুষের চোখের জলে শেষ বিদায় নিলেন কবি আব্দুর রফিক খান। বুধবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাশীপুরের শ্যামনগর গ্রামের নিজ বাসভবন সংলগ্ন পারিবারিক কবরস্হানে তার দাফন সম্পন্ন হল। ফুসফুসের সংক্রমণ জনিত কারণে তিনি ভুগছিলেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায় পরিস্হিতির অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও তিনি বাড়িতেই মারা যান। রেখে যান স্ত্রী হাসনুহানা বেগম, ছেলে জাভেদ ফেরদৌস খান ও মেয়ে ডোলা খান, আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী।
শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন কয়েক বছর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। সত্তরের দশকে কবি-সাহিত্যিক আব্দুর রব খান অধ্যাপক শান্তিময় রায়, ফুলরেণু গুহ ও পার্থ সেনগুপ্তের সঙ্গে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানে সামিল হন। পশ্চিমবঙ্গের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে বেড়ান।
উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদ জেলার সালার থানার সরমস্তপুরের ভূমিপুত্র তিনি।এই মানুষটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার কাশিপুর থানার পোলেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগদান করেন ১৯৮০ সালে। সেই থেকেই পোলেরহাটের পার্শ্ববর্তী শ্যামনগরে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতেন। তাঁর মরদেহ শ্যামনগরস্থিত বাসভবনে অগণিত ভক্তকুলের জন্য রাখা হয়।
মুর্শিদাবাদ জেলার পূর্বতন ভরতপুর (বর্তমান সালার) থানার অন্তর্গত অতি দুর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রাম সরমস্তপুরের এক বর্ধিষ্ণু কৃষক পরিবারের মাটির বাড়িতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন আবদুর রব খান। পিতা আবদুল খলিল খান ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। তৎকালীন সময়ে একজন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ও সরমস্তপুর গ্রামসভার অধ্যক্ষ ছিলেন। আর মা রাহিলা খাতুন ছিলেন অনুশীলন সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য। বড় দাদা আব্দুর খলিল খান ছিলেন বগুড়া মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন বাংলা ভাষা আন্দোলনের সৈনিক। রব খানের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রামেরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
গ্রামের স্কুলে স্বাধীনতা সংগ্রামী শিক্ষক মেহের আলির সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষকের কাছে ইংরেজ শাসকদের অন্যায় অবিচারের গল্প শুনতে শুনতে আর সমাজসেবি পিতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী মায়ের সংস্পর্শে নিজেকে ছোটবেলা থেকেই আপোষহীন চরিত্রের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন রব। এরপর দূরবর্তী গ্রামের তালিবপুর উচ্চ বিদ্যালয়য়ে ভর্তি হন। কিন্তু পরে টেঁয়ার স্কুল থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯৭০ সালে বর্ধমান জেলার কাটোয়া কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে সম্মানিকসহ স্নাতক ও ১৯৭২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই বছরই বঙ্গীয় সাক্ষরতা মিশন এর পত্রিকা ‘বর্ণপরিচয়’-এর সম্পাদকের চাকরি পান। এরপর ১৯৮০ সালে পোলেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০৯ সালে ৩০ বছরের এই বর্ণময় শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৭৮-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেন ‘রাহিলা’ মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। স্বাধীনতা সংগ্রামী মায়ের নামে নামাঙ্কিত এই পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বর্ণমিল’ নামে একটি ছাপাখানা। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে গৌরবের সঙ্গে প্রকাশিত হয় এই পত্রিকা। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রখ্যাত লেখক এই পত্রিকায় এক সময় লিখেছেন। ঈদসংখ্যা, পূজা সংখ্যা সহ বহু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন যা আজ ইতিহাস ও বহু গবেষকদের অনুসন্ধিৎসু মনের খোরাক যোগায়।
মূলত কবি এই মানুষটি বহু পাঠ্যপুস্তকসহ কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় পয়ত্রিশটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল অবশেষে, দুই প্রান্ত, আকাশ মাটির কাছাকাছি। উপন্যাস কদমতলার মাঝি, আজো বহে বাবলা, বাবলার ফুল, কংগ্রেসকে ভোট দিন ইত্যাদি।
১৯৭২ এ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সরকারি পর্যায়ে যে লেখকদল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে যায় আবদুর রব খান ছিলেন সেই দলের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। এই সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রচারবিমুখ এই কবি বহু লেখককে হাতে ধরে গড়েছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম