বাগেরহাটের চিতলমারীতে করোনাকালীন সময়ে (১৮ মাসে) পাঁচ শতাধিক স্কুল ছাত্রীর বাল্য বিয়ে হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্রতা, স্কুল বন্ধে যোগাযোগ বিচ্ছন্নতা, মোবাইল ফোনের অপব্যাহারসহ নানা প্রতিবন্ধকতার জন্য এ বাল্য বিয়ের হার বেড়েছে। অনেকে আবার প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেছে। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী পর্যন্ত এ বাল্য বিয়ে থেকে রেহাই পাইনি।
এখানে করোনার দেড় বছরে উপজেলা প্রশাসন ২৪ টি বাল্য বিয়ে বন্ধ করেছেন। বর্তমানে বাল্য বিয়ের শিকার ছাত্রীদের বিদ্যালয় মুখি করতে অভিভাবকদের নিয়ে সচেতনতামূলক কাজ চলছে। বুধবার (৬ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১২ টায় উপজেলা পরিষদ সভাকক্ষে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক সভায় বক্তাদের বক্তব্যে এ সব তথ্য জানা গেছে।
চিতলমারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মফিজুর রহমান জানান, ৪টি কলেজ, এক হাজার ৪০৯ ছাত্রী, একটি স্কুল এ্যান্ড কলেজে ১৮৩ জন, ৩১ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ হাজার ৯৫৯ জন, একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৩৯ জন, সংযুক্তি ৩টি কারিগরিতে ১২২ জন, ৩ টি দাখিল মাদ্রাসায় ৩৭৪ জন, একটি আলিম মাদ্রাসায় ১৬৬ জন ও ৩টি ফাজিল মাদ্রাসায় ২৬৮ জন ছাত্রী রয়েছে। মোট ৪৭ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ছাত্রীর সংখ্যা ৭ হাজার ৬২০ জন। এদের মধ্যে শুধু মাত্র ৩২ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫ হাজার ৯৮ জন ছাত্রীর মধ্যে ৪০৭ জন বাল্য বিয়ের শিকার ছাত্রীর হিসাব পাওয়া গেছে। বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে ৭ টি আলিয়া মাদ্রসায় কমপক্ষে আরও দেড় থেকে দুই শতাধিক ছাত্রীর বাল্য বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
করোনার মধ্যে এ উপজেলায় বাল্য বিয়ের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এ ছাড়া এ উপজেলায় ১১১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫০টির মত কওমি মাদ্রাসা রয়েছে।
এখানে যে সব বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে সে গুলো হলো, চিতলমারী সরকারি এস এম মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১১ জন ছাত্রী, চরবানিয়ারী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১১ জন, হাসিনা বেগম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৩৫ জন, বড়বাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৫ জন, চরডাকাতিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১ জন, ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০ জন, স ম, ইসাহাক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২জন, চরবড়বাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৯ জন, বোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০ জন, হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৮ জন,সাবোখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১০জন, বড়গুনি মেহেরুন্নেছা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৭ জন, জিডিবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১২ জন, রহমতপুর কলেজিয়েট স্কুলে ১৯ জন, সন্তোষপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ জন, ত্রিপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৫ জন, বড়বাড়িয়া জোনাব আলী ফকির মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৩৫ জন, কালশিরা রাজেন্দ্র স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩১ জন, সম্মলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১ জন, খড়িয়া-আরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ জন, মুক্তবাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৪ জন, স ম রকিবুজ্জামান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৭ জন, শান্তিখালি সবুজ সংঘ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৫ জন, বাহির দশমহল মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৯ জন, বোয়ালিয়া শান্তিপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৭ জন, চরবানিয়ারী ইউনিয়ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ৬ জন, কচুড়িয়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৭ জন, নবপল্লী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ জন, শৈলাদাহ এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ জন, গরীবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২ জন, পরানপুর শহীদ শেখ আবু নাসের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৫ জন, নবপল্লী নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ১৬ জন ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে।
বাল্য বিয়ের শিকার কলাতলা ইউনিয়নের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সাবিহা আক্তার (ছদ্মনাম) বলেন, ‘করোনায় লেখাপড়া বন্ধ ছিল। তাই বাবা-মা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন আমি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’
সাবিহার বাবা বলেন, ‘স্কুল বন্ধ ছিল। সংসাবে অভাব। মেয়েটার চেহারা সুন্দর। গ্রামের ছেলেরা ঝামেলা করত। তাই ভাল পাত্র পেয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।’
পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীর বিয়ের ব্যাপারে বড়বাড়িয়া মইজোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আছিয়া বেগম বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমাদের ওই ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যায়। স্কুল খোলার পর আমরা ওই ছাত্রীকে ক্লাসে ফিরিয়ে এনেছি। বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
চিতলমারী হাসিনা বেগম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শৈলেন্দ্রনাথ বাড়ৈ জানান, ‘করোনাকালে স্কুল বন্ধের মধ্যে তাদের অজান্তে তাঁর বিদ্যালয়ের ৩৫ জন মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে। এদের অধিকাংশই নবম ও দশম শ্রেনীর ছাত্রী।’
চিতলমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহামান জানান, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে তাদের কর্মকান্ড চলমান রয়েছে।
চিতলমারী উপজেরা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. লিটন আলী বলেন, ‘বাল্যবিয়ে বন্ধে উপজেলা প্রশাসন সব সময়ই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। করোনার দেড় বছরে ২৪টি বাল্য বিয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে বন্ধ করা হয়েছে। এ সময় জরিমানার পাশপাশি মুচলেকা নিয়েছি।’
খুলনা গেজেট/ এস আই