চার বছরেও নির্মাণকাজ শেষ হয়নি খুলনার খালিশপুর চিত্রালী কিচেন মার্কেটটির। এখনও বন্ধ রয়েছে প্রকল্পের নির্মাণকাজ। প্রকল্পের কাজ বন্ধ থাকায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে তারা মার্কেট সংলগ্ন রাস্তায় ও তার আশপাশে খোলা আকাশের নিচে ছাউনি দিয়ে ব্যবসা করছেন। এতে ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনই যানবাহন চলাচলের পথটি বন্ধ রয়েছে। মাছ ও মুরগিরসহ বর্জ্যের দুগর্ন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার বসবাসকারী ও পথচারীরা।
খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান বলেন, মার্কেট নির্মাণের জন্য উচ্ছেদের সময় ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসনের আশ্বাস দেওয়া হলেও চার বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১৯ সালে মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু হয়। কাজ শুরুর দুই বছরের মাথায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেই সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ যথাযথ প্রক্রিয়ায় করেনি। ১১ মাসে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ২৩ মাসেও কাজ শেষ হয়নি। ঠিকাদারের ব্যর্থতার কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আরও প্রায় দুটি বছর কেটে গেছে। চার বছরে ৫০০ ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতাধিক ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে চলে গেছে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বাড়িওয়ালারাও ক্ষতিগ্রস্ত। মাছ, মুরগির বর্জ্যের গন্ধে সড়কে মানুষের চলাচলে সমস্যা হয়। একসময় মার্কেটে মানুষ রিকশা, ভ্যান, গাড়িতে করে আসতো। চার বছর আর সেই পরিবেশ নেই। ক্রেতারা চলে যাচ্ছে দৌলতপুরসহ বিভিন্ন মার্কেটে। নতুন মার্কেট তৈরি না হলেও পাশের পুরাতন মার্কেটের ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা আরও সমস্যায় পড়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি পুনরায় মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আধুনিক মানের এই মার্কেটের নির্মাণকাজ শেষ করার দাবি জানান তিনি।
খুলনা সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটটি (চিত্রালী কিচেন) নতুনভাবে গড়ে তুলতে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৮৯ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করে কেসিসি। নানা প্রক্রিয়া শেষে প্রকল্পটি অনুমোদনের পর বিএমডিএফের আওতায় মিউনিসিপ্যাল গভর্ন্যাস সার্ভিসেস প্রজেক্টের (এমজিএসপি) অর্থায়নে কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সোমা ইঞ্জিনিয়ারিং এমএসই-এমডিই (জেভি)। ২০১৯ সালের ১২ জুন কার্যাদেশ দেওয়া হয়। পুরাতন মার্কেট অপসারণসহ নানা জটিলতায় মার্কেট নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ মার্চ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তা পারেনি ঠিকাদার। পরে দুদফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়। বেজমেন্টসহ চারতলা ভিত্তির (ফাউন্ডেশন) মার্কেটটি প্রাথমিকভাবে সেমিবেজমেন্টসহ একতলা করার কথা। কিন্তু কাজের গতি অত্যন্ত মন্থর, যা দাখিলকৃত হালনাগাদ কার্যপরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ফলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় ২০২১ সালের ১৬ জুন বিএমডিএফ (বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড) কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। যদিও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের ৭৩ দশমকি ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে চার দফায় মোট ৭ কোটি ৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকার বিল উত্তোলন করে নেয়। এরপর কেটে গেছে দুই বছর। এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত রয়েছে ২৬ দশমিক ২০ শতাংশ নির্মাণকাজ।
এদিকে চলতি বছরে খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেটের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নের উদ্যোগ নিয়েছে খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি)। ইতোমধ্যে মার্কেট নির্মাণের কার্যাদেশ সম্পন্ন হয়েছে। তবে প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজটি পেয়েছে একই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সোমা ইঞ্জিনিয়ারিং। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ২৮ হাজার টাকা। চলতি বছরের ২৫ মে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। নতুন করে মার্কেটটি নির্মাণের খবরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফের আশা জেগেছে।
মাংস বিক্রেতা ইউনুস আলী বলেন, আগে জমজমাট ব্যবসা ছিল। কিন্তু মার্কেট ভেঙে ফেলার পর পাশে গলিতে মাংস বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন আর তেমন ক্রেতা নেই। লাভও তেমন হয় না।
সবজি বিক্রেতা সালাম শরীফ বলেন, রোদ-বৃষ্টিতে এখানে বেচাকেনা করতে হয়। বৃষ্টিতে পানি জমে কাদা হয়। মালামাল নষ্ট হয়। চুরির আশঙ্কা নিয়েও রাতে মালামাল রাস্তার উপর রাখতে হয়। আমাদের মার্কেট ও নতুন করে সড়কের প্রয়োজন।
আরেক সবজি বিক্রেতা ফারুখ হোসেন দুলাল হাওলাদার বলেন, মার্কেটটি না হওয়ায় প্রায় চার বছর ধুকে ধুকে মরছি। ক্রেতা তেমন নেই। তারা দৌলতপুর, হাউজিং বাজারে চলে যায়। মার্কেটটি হবে শুনেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে হলে স্বস্তি পাব।
মাছ বিক্রেতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, রাস্তার পাশে গলিতে শেড তৈরি করে মাছ বিক্রি করছি। মানুষ চলাচল করতে পারে না। মাছে পানি ছেটানো হলে ক্রেতারা চলাচল করতে পারে না। আর চিপা গলিতে নারী ক্রেতারা তো আসতেই চায় না। আগে সারাদিন ব্যবসা হতো আর এখন বসে থেকেও তেমন ক্রেতা পায় না।
খালিশপুর পৌর সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাফেল ফেরদৌস রানা বলেন, নির্মানাধীন মার্কেটের ব্যবসায়ীরা সড়কের ওপর ছাউনি দিয়ে কোন রকম ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী সাহাবুল আলম বলেন, করোনার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ফলে কাজ শেষের আগেই প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। তবে পুনরায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ঈদের পর পুরোদমে কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদী।
প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, চারতলা ফাউন্ডেশনের মার্কেটটির বেজমেন্ট করা হলেও গ্রান্ড ফ্লোরের কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। লোকাল গভার্নমেন্ট কোভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্টে মাকের্টের একতলা কমপ্লিট করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী শনিবার লে-আউট দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করছি সব কিছু ঠিক থাকলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।
ঠিকাদার তাহিদুল ইসলাম ঝন্টু বলেন, মার্কেটের বেজমেন্ট এবং পিলারের কাজ শেষ করেছিলাম। তবে করোনার কারণে কাজ ঠিকমতো করতে পারিনি। এর মধ্যেই ওয়াল্ড ব্যাংক প্রকল্প বাতিল করে দেয়। পুনরায় করোনা প্রজেক্টে প্রকল্পের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান প্রকল্পটির কাজ ১০নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরুল ইসলাম ও তিনি যৌথভাবে শেষ করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ঈদের পর কাজ শুরু করা হবে। এখন ছাদ ঢালাই ও ফিনিশিংয়ের কাজ করতে হবে। আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে মার্কেটের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।