খুলনার পাইকগাছায় চতুর্মুখী পরকীয়ার জেরে পুস্পেন্দু বিকাশ (বাবু) হত্যা মামলার বাদী নিহতের স্ত্রী অনুভা মন্ডল নিজেই এখন কারাগারে। চলতি মাসের ১০ জানুয়ারি পাইকগাছার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার ধার্য্য দিনে শুনানিতে বিজ্ঞ বিচারক বাদীকে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
ইতোমধ্যে হত্যাকান্ডের পরিকল্পনায় অন্য আসামিদের সাথে অনুভা’র জড়িত থাকার অভিযোগে সিআইডি তার বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক (চার্জশিট) অভিযোগ পত্র দাখিল করলে তা গৃহীত হয়।
এরআগে থানা পুলিশের তদন্ত সহ ডিবি পুলিশ তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট প্রদান করেন। এ হত্যা মামলার আসামি পবিত্র মন্ডল, সুজন রঞ্জন, এজাহার নামীয় একরামুল, শামিম ও নিহতের শ্বাশুড়ি নীলা জামিনে মুক্ত রয়েছে ও অপর আসামি গৌর বাইন পালাতক রয়েছে।
জানা যায়, গত ১৬ সালের ২৯ নভেম্বর রাত আনুমানিক ৮টার দিকে পুস্পেন্দু বিকাশ ওরফে বাবু উপজেলার সুড়িখালী বাজার থেকে মোটরসাইকেল যোগে নিজ বাড়ী বগুড়ারচকের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এক পর্যায়ে রহিম হাজীর ঘের সংলগ্ন এলাকায় পৌছালে পিছন থেকে মোটরসাইকেলে এসে ভাড়াটিয়া খুনি কয়রার চান্নিরচকের শামিম গাজী (২৪), একরামুল গাজী (১৭), পাটনীখালীর সুজন রঞ্জন (৩০) মৃত বাবু’র মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে তাকে নির্মম ভাবে খুন করে পালিয়ে যায়। খুনের পর শামিম ও একরামুল মোটরসাইকেলে চান্নিরচকের দাইপাড়ায় পৌছালে মোটরসাইকেলের চেইন ছিড়ে য়ায়। এসময় তারা গাড়ী রেখেই পালিয়ে যায়। যা পরদিন পুলিশ উদ্ধার করে।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী অনুভা মন্ডল বাদী হয়ে শামিম, একরামুল সহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে পাইকগাছা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। খুনের একদিন পর স্থানীয়দের সহায়তায় কযরার নারায়নপুর বাজারের একটি সেলুন থেকে শামিমকে গ্রেপ্তার করেন ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন এসআই স্বপন কুমার রায়। শামিমের দেওয়া তথ্যানুযায়ী অপর আসামি একরামুল গ্রেপ্তার হয়। এরা দু’জনই খুনের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী দেয়।
তদন্তের এক পর্যায়ে আলোচিত মামলাটি ৩১-৮-১৭ সালে গোয়েন্দা পুলিশ ( ডিবি) তে হস্তান্তর করে আদালত। ডিবি’র ইন্সপেক্টর এসএম আলমগীর কবির তদন্তে প্রাপ্ত পলাতক আসামি কয়রার পাটনিখালী গ্রামের পবিত্র মন্ডল (৩০)কে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে ফৌঃ কাঃ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড করান। তদন্তের এক পর্যায়ে তার বদলী হলে ডিবি’র ৩য় তদন্তকারী পুলিশ পরিদর্শক গোপাল চন্দ্র রায় উক্ত মামলার তদন্তভার পেলে ওই আলোচিত হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন হয়।
যে কারণে খুন হয় পুস্পেন্দু
থানা পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি’র পুলিশ পরিদর্শক খান গোলাম ছরোয়ারের দেয়া সম্পূরুক অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বিয়ের পর পুস্পেন্দু বিকাশ বাবু ( ৪০) ও স্ত্রী অনুভা মন্ডলের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল। তাদের সাংসারিক জীবনে পুত্র ত্রিদিপ ও কন্যা অর্নি জন্ম গ্রহণ করে।
এরই মধ্যে বাবু’র শ্যালিকা স্মৃতিকনা মন্ডল ও পশ্চিম বাইনবাড়ীয়ার গৌরপদ বাইনের মধ্যে প্রেমজ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ঘটনার জানাজানির এক পর্যায়ে পুস্পেন্দু ও গৌর বাইনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হাতাহাতি হলে শ্বাশুড়ির অনুরোধে শ্যালিকা স্মৃতিকনাকে পুস্পেন্দু নিজের বাড়ীতে নিয়ে আসে। সেখানে কিছুদিন যেতে না যেতেই পুস্পেন্দু ও শ্যালিকা স্মৃতিকনার মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এ ঘটনায় পুস্পেন্দু ও স্ত্রী অনুভা’র মধ্যে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
এদিকে পুস্পেন্দুর বন্ধু পাটনীখালীর পবিত্র মন্ডল বগুড়ারচকে পুস্পেন্দুর বাড়ীতে আসলে স্ত্রী অনুভার সাথে পরিচয় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে পবিত্র ও অনুভা দু’জনে নতুন করে প্রেমজ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। চর্তুমুখি সম্পর্কের জেরে পুস্পেন্দু-অনুভা দম্পতি সংসারে চরম সংকট দেখা দেয়। তিক্ততার এক পর্যায়ে শ্বাশুড়ি নীলা, স্ত্রী অনুভা, শ্যালিকার পর্ব প্রেমিক গৌরপদ ও পবিত্র মন্ডল মিলে পুস্পেন্দু বাবুকে খুনের পরিকল্পনা করে।
যে ভাবে খুন করা হয়
খুনের ১ সপ্তাহ আগে পবিত্র’র চায়ের দোকানের পিছনে শামিম, একরামুল, গৌরপদ ও সুজন একত্রে বসে হত্যার পরিকল্পনা করে। এ সময় পুস্পেন্দুকে খুন করার জন্য বন্ধু পবিত্র শামিম ও একরামুলকে ৫০ হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি হয়ে ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ২০১৬ সালের ২৯ নভেম্বর শামিম ও একরামুল সন্ধ্যার পুর্বে শুড়িখালী ব্রীজের কাছে পরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান নেয়। এরপর বাবু এক শুড়িখালী বাজরের কাজ শেষে রাত ৮ টার পর মোটরসাইকেল যোগে বাড়ী ফেরার পথিমধ্যে পবিত্র মোবাইলে শামিম ও একরামুলকে জানিয়ে দিলে তারাও একটি মোটরসাইকেলে পিছু নেয়।
বাবু পাতড়াবুনিয়া রহিম হাজীর ঘের সংলগ্ন এলাকায় পৌছালে শামিম, একরামুল গংরা তার গতিরোধ করে ধারালো অস্ত্র ও হাতুড়ি দিয়ে বাবু’র মাথায় আঘাত করে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে পালিয়ে যায়। এরপর স্থানীয়রা তাৎক্ষণিক বাবুকে উদ্ধারপূর্বক হাসপাতালে নেওয়ার পথিমধ্যে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
মামলার সর্বশেষ
এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী অনুভা মন্ডল বাদী হয়ে শামিম, একরামুল সহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সর্বশেষ এ মামলার বাদী অনুভা মন্ডল স্বামী হত্যায় জড়িত থাকায় আদালতের নির্দেশে তাকে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হলে তার ছেলে ত্রিদীপকে কে বা কারা হুমকি দিচ্ছে এ মর্মে থানায় একটি জিডি হয়েছে।
এ ব্যাপারে পাইকগাছা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ জিয়াউর রহমান জানান, স্বামী হত্যায় জড়িত থাকায় স্ত্রী অনুভাকে আদালতের নির্দেশে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। অপরদিকে ছেলেকে হুমকির ঘটনায় জিডি’র বিষয়েও গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
খুলনা গেজেট/ এস আই