উপকূলীয় জেলা খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকায় বেড়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ। লবন সহিঞ্চু ও অফসিজনে চাষের উপযোগী বারি উদ্ভাবিত ৩টি জাতের মধ্যে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো- ৮’ কৃষক ও ভোক্তার মন জয় করেছে। উচ্চ ফলন ও বেশ দাম পাওয়ায় কৃষকরা বেজায় খুশি। আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে মেটাচ্ছে ভোক্তার পুষ্টির চাহিদাও।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নগরঘাটা গ্রামের মো. মাসুদ হোসাইন আড়াই লক্ষাধিক টাকা খরচ করে দুই বিঘা জমিতে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-৮’ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, গত শনিবার প্রথম ৬৫ টাকা দরে ৩০ কেজি টমেটো বিক্রি করেছি। কোন সমস্যা না হলে এবছর ৭/৮ লাখ টাকার টমেটো বিক্রি করতে পারবো ইনশাল্লাহ। তিনি আরও জানান, গেল বছর সাত লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি করেন। ডিগ্রী পাশ করার পর তিনি আত্মকর্মসংস্থানের দিকে মনোনিবেশ দেন। অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর, সরেজমিন গবেষণা বিভাগ ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামক একটি এনজিও’র সহায়তায় কৃষিক্ষেত্রে তিনি ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছেন।
খুলনার কয়রা উপজেলার ৪ নং কয়রা গ্রামের গোপাল সরদার জানান, গত বছর ২০ শতক জমিতে টমেটোর চাষ করেন। শ্রমিকের মজুরীসহ ৪০ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি করেন তিনি। এবছরও একই জমিতে বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ চাষ করেছেন। খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ১৫/২০ দিন পর টমেটো বিক্রি শুরু করতে পারবেন। গত বছরের তুলনায় ফলন বেশি হবে বলে তিনি আশাবাদি। গত বছর সরেজমিন বিভাগ থেকে তাকে পরামর্শের পাশাপাশি বীজ, সার ও কিছু সরঞ্জাম দিয়েছিলেন। এ বছরও তাকে সার ও বীজ দেয়ায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

একই উপজেলার উত্তর বেদকাশি গ্রামের মোখলেসুর রহমান খুলনা গেজেটকে জানান, এ বছর প্রথম উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে ১৫ শতক জমিতে টমেটোর চাষ করেছেন। কৃষি অফিস থেকে তাকে বীজসহ অধিকাংশ খরচ দেয়া হয়েছে। বেশ লাভ পাবেন বলে তিনি আশা করছেন। তবে তার এলাকায় কয়েকজন চাষি নিজেদের উদ্যোগে চাষ করেছেন, তাদের ফলন আরও ভালো।
কয়রার মহারাজপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রভাষক মো. শাহাবাজ আলীও দেড় বিঘা জমিতে বারী টমেটো-৮ চাষ করেছেন। তার গাছে ব্যাপক ফল আসছে।

রূপসা উপজেলার তিলক গ্রামের মলয় কুমার ঘোষ উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহায়তায় ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-১১’ চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার টমেটো বিক্রি হয়েছে। আরও দেড় লক্ষাধিক টাকার টমেটো বিক্রি হবে বলে তিনি আশা করছেন।
খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা গ্রামের চাষি পলাশ রায় বলেন, সরেজমিন বিভাগ থেকে বীজ পেয়ে এবার প্রথম চাষ করি। খুব ভাল না হলেও মোটামুটি ফলন পেতে পারি।
একই উপজেলার বটবুনিয়া গ্রামের টুকু শেখ বলেন, আনুমানিক ১২শ’ চারা লাগিয়েছি। প্রাকৃতিক দূর্যোগে সমস্যা না হলে ইনশাল্লাহ প্রতি গাছ থেকে ৮/১০ কেজি টমেটো পাব। পূঁঁজি স্বল্পতায় বাঁশের শেড করতে পারিনি।
তবে পানির সমস্যায় ও শেড করতে না পারায় ওই এলাকার বেশ কিছু চাষি ফলন ভালো আশা করছেন না।
বারি’র খুলনা অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খুলনা ও সাতক্ষীরা কার্যালয় থেকে জানা যায়, এ বছর সাতক্ষীরা জেলায় ৯৫ হেক্টর ও খুলনা জেলায় ৩৫ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চাষ হয়েছে। বারি টমেটোর ১১টি হাইব্রিড জাত উদ্ভাবন করেছে। উদ্ভাবিত জাতের মধ্যে বারি ‘হাইব্রিড টমেটো-৪, ৮ ও ১১’ গ্রীষ্মকালীন জাত হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। চলতি বছর বেশি চাষ হয়েছে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-৮’। এটির স্বাদ অনেক ভালো। সাদা পলিথিন ও বাঁশের ছাউনি দিয়ে শেড করে এই টমেটোর চাষ করতে হয়। প্রথম বছর জমিতে শেড তৈরিতে খরচ একটু বেশি হয়। তবে পরের বছর থেকে খরচ কমে যায়। বারি হাইব্রিড টমেটো-৪, ৮ ও ১১ জাতের গড় ফলন হেক্টর প্রতি ৩৫-৪০ মেট্রিক টন। বিঘা প্রতি দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত নিট মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। সাধারণত মে-জুন মাসে চাষ শুরু করতে হয়। জুলাই-আগস্টে ফল আসতে শুরু করে। একাধারে নভেম্বর -ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত টমেটো পাওয়া যায়।
দাকোপের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের বৈজ্ঞানিক সহকারি বিপুল জানান, গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষে উদ্বুদ্ধ করতে প্রথমবারের মতো ৩০ জন চাষিকে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-৮’ জাতের বীজ দেয়া হয়। পানির সমস্যায় বেশির ভাগ চাষির চারা নষ্ট যায়। ৩৫/৪০ শতাংশ চাষি সন্তোষজনক ফল পাবেন বলে আশা করছি।
সরেজমিন বিভাগের বৈজ্ঞানিক সহকারী অমরেশ চন্দ্র সরকার বলেন, বারি’র আওতায় দুটি প্রকল্প থেকে সাতক্ষীরায় ৩৫০ বিঘা জমিতে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-৮’ চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ বছর বিঘা প্রতি ২শ’ মণ ফলন আশা করছি।
কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান বলেন, লবনাক্ততার মধ্যেও গ্রীষ্মকালীন টমেটোর সন্তোষজনক ফলন পাচ্ছে কৃষকরা। ফলে চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে।
রূপসা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ ফরিদুজ্জামান বলেন, উপজেলায় প্রথমবারের মতো পাঁচ বিঘা জমিতে ‘বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ ও ১১’ জাতের চাষ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সাতক্ষীরার উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এস,এম খালিদ সাইফুল্লাহ খুলনা গেজেটকে বলেন, এ বছর জেলায় ৩টি জাতের গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী ‘বারী হাইব্রিড টমেটো-৮’। এ এলাকার কৃষকরা বেশ লাভবান হচ্ছে এবং এটি চাষে আগ্রহ বেড়েছে।
বারি’র খুলনা অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: হারুনর রশিদ খুলনা গেজেটকে জানান, গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে টমেটো চাষ হতো না, ভারত থেকে টমেটো আসত। সেটার মধ্যে কোনো স্বাদ ছিল না। এই টমেটোর জাত আবিষ্কারের ফলে বিদেশ থেকে কোনো টমেটো আমদানির প্রয়োজন হবে না। একদিকে আমাদের কৃষকেরা ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছে। অন্যদিকে আমরা বিষমুক্ত পুষ্টিকর টাটকা সবজি খেতে পারছি।
খুলনা গেজেট/ টি আই