বিশ্বজুড়ে দেখা যায়, কিশোর বয়সে ছেলেরা সাধারণত মেয়েদের তুলনায় গণিতে ভালো করে এবং পরবর্তী সময়ে গণিত ও এ সম্পর্কিত পেশায় পুরুষদের অংশগ্রহণ বেশি। অথচ শিশু বয়সে ছেলেদের মধ্যে সংখ্যা বোঝার বা যৌক্তিক চিন্তার কোনো প্রাকৃতিক প্রাধান্য দেখা যায় না। সম্প্রতি ফ্রান্সে প্রায় ৩০ লাখ স্কুলশিশুর ওপর করা এক বিশাল গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েরা গণিতে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই।
গবেষণায় দেখা যায়, স্কুলের শুরুতে ছেলেমেয়েরা গণিতে প্রায় সমান নম্বর পেলেও মাত্র চার মাস পর থেকেই ছেলেরা এগিয়ে যেতে শুরু করে। আর ১২ মাসের মধ্যেই এই পার্থক্য অনেক বড় হয়ে যায়। এই গবেষণাটি ১১ জুন, ২০২৫ এ Nature জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী জিলিয়ান লাউয়ার বলেন, “এই গবেষণা বলছে, শিশুদের গণিতে মেয়েদের পিছিয়ে পড়া কোনো জৈবিক বা অবশ্যম্ভাবী বিষয় নয়। যদি আমরা মেয়েদের পিছিয়ে পড়া ঠেকাতে চাই, তাহলে স্কুলের শুরুতেই তাদের অভিজ্ঞতার দিকে নজর দিতে হবে।”
গবেষকেরা কিছু সম্ভাব্য সমাধানও দিয়েছেন: গণিতভীতি (Math Anxiety) কমাতে মানসিকভাবে সহায়তা দেওয়া, ক্লাসে ছেলেমেয়েদের সমানভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেওয়া, এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরেও সমস্যা সমাধানের কৌতূহল তৈরি করা।
“নৈতিক দিক থেকে আমরা চুপ থাকতে পারি না, যখন এমন ফলাফল সামনে আসে,” বলেন গবেষণাটির অন্যতম গবেষক, নিউরোবিজ্ঞানী পলিন মার্টিনো।
এ বিষয়ে বিশদ গবেষণা
এই গবেষণা আগের যেকোনো গবেষণার চেয়ে বিস্তৃত। এতে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে প্রথমবার স্কুলে যাওয়া সব ফরাসি শিশুর তথ্য অন্তর্ভুক্ত আছে — প্রায় ৩০ লাখ পাঁচ, ছয় ও সাত বছর বয়সী শিশু। দেখা গেছে, দেশজুড়ে সব ধরনের স্কুল, অঞ্চল এবং অর্থনৈতিক পটভূমির মধ্যেই একই চিত্র — মেয়েরা প্রথম বছরেই পিছিয়ে পড়ছে।
গবেষকরা বড় ডেটার সাহায্যে দেখিয়েছেন, বয়স নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরুই এই পার্থক্যের সূচনা করে। ফ্রান্সে, শিশুদের স্কুল শুরু হয় তারা যেই ক্যালেন্ডার বছরে ছয় বছর পূর্ণ করে, সেই সেপ্টেম্বর মাসে। গবেষকেরা এমন শিশুদের তুলনা করেছেন যাদের জন্ম তারিখে কয়েকদিনের পার্থক্যের কারণে তারা ভিন্ন স্কুল বর্ষে পড়েছে। দেখা গেছে, যেসব ছেলে-মেয়ে ডিসেম্বরে জন্ম নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে, তাদের মধ্যে গণিত পারফরম্যান্সে পার্থক্য রয়েছে। অথচ জানুয়ারিতে জন্ম নেওয়া এবং প্রথম বর্ষে থাকা একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই পার্থক্য নেই।
গবেষকেরা বলেন, প্রথম বছরে ছেলেমেয়ের মধ্যে গড় পারফরম্যান্সে কোনো বড় ফারাক না থাকায় বোঝা যায়, সমস্যার মূল কারণ হতে পারে স্কুল শুরু হওয়ার পর তাদের পরিবেশগত অভিজ্ঞতা।
লাউয়ার বলেন, “এটা ঠিক, কোনো অজানা জৈবিক কারণও থাকতে পারে যেটা আমরা এখনো গণিত বা স্থানিক চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারিনি তবে এই গবেষণা বলছে, তাদের বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
শিশু বয়সে ছেলেমেয়েরা সংখ্যাবোধ ও যৌক্তিক চিন্তায় প্রায় একইরকম দক্ষতা দেখায়।
কেন মেয়েরা পিছিয়ে?
সম্ভাব্য একটি কারণ হতে পারে শিক্ষকদের বা অভিভাবকদের আচরণ। অনেক সময়ই তারা অজান্তেই ছেলেদের গণিতে ভালো বলার বা তাদের সাফল্যকে প্রতিভা হিসেবে দেখানোর প্রবণতা দেখায়, যেখানে মেয়েদের সাফল্যকে পরিশ্রমের ফল বলা হয় — যা মেয়েদের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে।
স্কুলে গণিতকে আলাদা সময়সূচি ও বই দিয়ে “গণিত” হিসেবে চিহ্নিত করা হলে মেয়েরা সেসময় থেকেই এই সামাজিক স্টেরিওটাইপ নিজেদের উপর প্রয়োগ করতে শুরু করে। এছাড়া মেয়েদের মধ্যে গণিত নিয়ে ভয় বা দুশ্চিন্তা ছেলেদের তুলনায় বেশি — ফলে সময় নির্ধারিত পরীক্ষায় তাদের পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক মেঘনা নাগ চৌধুরী বলেন, গণিতে “ভালো” হওয়ার সংজ্ঞাও আরও বিস্তৃত করা দরকার। শুধুমাত্র দ্রুত উত্তর দেওয়াকেই দক্ষতার মাপকাঠি না ধরে, কোনো সমস্যার অভিনব সমাধান খুঁজে পাওয়াকেও সেইভাবে মূল্যায়ন করা উচিত।
“আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত না যে মেয়েদের ছেলেদের মতো হতে বাধ্য করে। বরং স্কুলিং-কে আরও বিস্তৃত করতে হবে।”
খুলনা গেজেট/এসএস