রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গত শুক্রবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার এবং সহসমন্বয়ক রশিদুল ইসলাম রিফাত নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ ওঠে। সোমবার রাতে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের সামনে সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও এই অভিযোগ তোলা হয়।
তবে বুধবার (২৪ জুলাই) রাজধানীর দুটি স্থান থেকে দু’জন সমন্বয়ককে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সহসমন্বয়কের ‘খোঁজ’ পাওয়ার কথা শোনা গেলেও সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদের খোঁজ মিলেছে বলে সোমবার দুপুরে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন সংগঠনের সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। বিকেলে আসিফ মাহমুদের নম্বর থেকে গণমাধ্যমে একটি খুদেবার্তা আসে। এতে লেখা ছিল, ‘গত ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত ১১টায় আমাকে হাতিরঝিলের মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যায়। আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। বুধবার বেলা ১১টায় আবার একই জায়গায় চোখ বাঁধা অবস্থায় ফেলে দিয়ে যায়। আমি এখন পরিবারের সঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসারত আছি।’ বুধবার সন্ধ্যায় তাঁর ওই নম্বরে কল দেওয়া হলেও কেউ ফোন ধরেননি।
তবে আসিফকে পাওয়া গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস ইসলামও। তিনি বলেন, আসিফ মাহমুদকে পাওয়া গেছে। তাঁর সঙ্গে আমাদের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও মাহিন সরকার এবং সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলামের কথা হয়েছে। আমিও ফোন দিয়েছিলাম। তবে কেউ ফোন রিসিভ করেননি। তিনি বলেন, ‘ছাড়া পাওয়ার পর আসিফ আমাদের সহসমন্বয়ক হাসিবকে ফোন দেন। হাসিব তখন কাছাকাছি অবস্থান করা একজন সহসমন্বয়ককে ফোন দেন। সেই সহসমন্বয়ক আসিফকে তাঁর পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বিষয়টি হাসিব আমাকে নিশ্চিত করেছেন।’
শুক্রবার সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির একটি গলি থেকে নিখোঁজ হন আরেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। গতকাল তারও খোঁজ মিলেছে। বাকের গণমাধ্যমকে তাঁর অবস্থানের বিষয় নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। আমি এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত জানাব।’
এ ছাড়া এক ফেসবুক পোস্টে বাকের জানান, ‘আমাকে গত ১৯ জুলাই সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির গলি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং আন্দোলন বন্ধে স্টেটমেন্ট দিতে বলায় আমি অস্বীকৃতি জানালে একটা অন্ধকার রুমে আটকে রাখে। গতকাল যে এলাকা থেকে তুলে নেয়, তার পাশের এলাকায় আমাকে চোখ বেঁধে ফেলে রেখে যায়। আমি এখন আমার পরিবারের সঙ্গে নিরাপদে আছি। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আপনাদের সামনে বিস্তারিত কথা বলব।’
তবে গত রাতে সহসমন্বয়ক রিফাত তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ‘রিফাত রশিদ’ থেকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে তিনি অল্পের জন্য ‘নিখোঁজ’ হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি লিখেন, ‘আমি ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দিয়েছিলাম এবং সবাইকে ফোনে কানেক্ট করার চেষ্টা করছিলাম এই আশায় যে, সমন্বয়ক প্যানেলের কারও সঙ্গে কানেক্ট করতে পারব। কিন্তু যাত্রাপথে আমার ওপর অ্যাটাক আসে। সাদা পোশাকের লম্বা দুইজন মানুষের ধাওয়া খাই জিগাতলার দিকে। কোনোভাবে একটা অপরিচিত মানুষের বাসায় আশ্রয় নিই। সেই পরিবারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ আজীবন। পরদিন ইনফরমেশন এসেছে আসিফ ভাই, বাকের ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে, আমাকেও গুম করার জন্যই ধাওয়া দেওয়া হয়েছিল, সেটা তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম। আমাদের সমন্বয়ক প্যানেলের সিদ্ধান্ত ছিল, যদি আমাদের অ্যারেস্ট-গুম করা শুরু করে, তখন সেকেন্ড লেয়ার লিডারশিপ সেইফ থাকবে, ফার্স্ট লেয়ার লিডারশিপকে যদি রাজপথ থেকে পুরো সরিয়ে ফেলা হয়, তখন সেকেন্ড লেয়ার লিডারশিপ নেতৃত্ব দেবে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘এই সিদ্ধান্ত মেনেই আমি সেইফ জোনে গিয়েছিলাম। তারপর এই সাপলুডুর জীবন, আজ এর বাড়ি তো কাল ওর বাড়ি। এর মাঝে যতবার ফোন অন করে কানেক্ট করার চেষ্টা করেছি, ফোন ট্র্যাকের শিকার হয়েছি। বাধ্য হয়ে যেই ফ্যামিলিগুলো আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার জন্য ফোনটাকেও অন করতে পারিনি একটি বারের জন্যও।’ স্ট্যাটাসে তিনি নিরাপদে আছেন বলে উল্লেখ করে লেখেন, ‘সবাইকে জানাচ্ছি যে, আমি নিরাপদে আছি এই মুহূর্ত পর্যন্ত। কিন্তু জানি না কতক্ষণ আর নিরাপদে থাকব। আপনারা শহীদ আর নির্যাতিত ভাইদের ভুইলেন না। তাদের রক্ত, ত্যাগকে ভুইলেন না।’
বুধবার রাত ৮টা ১২ মিনিটে রিফাতের বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকন বলেন, আমাকে একজন দেখাল যে, রিফাত যে নিরাপদে আছে তা সে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছে। রিফাতের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়নি। আমাকে সে কোনো ফোন দেয়নি। শুধু ফেসবুকে পোস্ট দেখে এ কথা জানতে পেরেছি।
রাত সোয়া ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, রিফাতের বাবা কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছেন যে, রিফাতের খোঁজ পাওয়া গেছে। রিফাত নাকি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছে, সে নিরাপদে আছে।
এর আগে দুপুরে রিফাতের বাবা দেলোয়ার হোসেন খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, গত শুক্রবার সকালে রিফাতের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। এরপর থেকে তাকে আমরা পাচ্ছি না। সে কোথায় আছে, কারা তুলে নিয়ে গেছে– কিছুই জানি না। রিফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী। বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছি। তারাও রিফাতকে খুঁজছেন বলে জানিয়েছেন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়তো তাকে তুলে নিতে পারে।
দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি নিজেও ঢাকায় এসেছি রিফাতকে খুঁজতে। এমনকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গেও খুঁজেছি। কিন্তু তাকে পাইনি। গত পরশু আমি শাহবাগ ও নিউমার্কেট থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু থানা থেকে আমার ডায়েরি নেওয়া হয়নি। আমি আমার সন্তানের সন্ধান চাই।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান বুধবার রাত ৮টায় রিফাতের কোনো খোঁজ পাননি বলে জানান। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে রিফাতের ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, রিফাত কোথা থেকে পোস্ট দিয়েছে, সেটা এখন দেখার বিষয়। কাস্টডির মধ্যে থেকেও তো ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ানো হতে পারে। এই পোস্টের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
এসব বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, এই ধরনের ঘটনা উদ্বেগজনক ও অগ্রহণযোগ্য। নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হোক।
সূত্র : সমকাল
খুলনা গেজেট/এইচ