কখনো দাউ করে, আবার কখনো মৃদুলয়ে পুড়ছে কাঠ। ধোাঁয়া ছেয়ে যাওয়ায় গোটা এলাকায় দম বন্ধ হবার যোগার (অবস্থা)। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ-গাছ, ফসল। রূপসার রামনগর, রহিমনগরসহ রূপসা নদীর তীরে চিত্র প্রতিদিনকার। প্রশাসনের অভিযানও হয়েছে। স্থানীয়দের আপত্তিরও শেষ নেই। কিন্তু কাঠ পুড়িয়ে এ ধ্বংসযজ্ঞ থামছে না। শুধু রূপসাই নয় খুলনার বিভিন্ন উপেজেলায় কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির শতাধিক চুল্লির ধোঁয়ায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ চরম হুমকিতে পড়েছে। প্রশাসনের অভিযানের পর সাময়িক বন্ধ থাকলেও ফের চালু করছে তারা। জনবল সংকটে বার বার অভিযানে হিমসিম খাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর উচ্ছেদ অভিযানের অর্থ ও কারিগরী সহায়তা না থাকায় স্থানীয় প্রশাসন পরিবেশ অধিদপ্তরকে জানিয়ে সময়ের অপেক্ষা করছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, খুলনার রূপসা উপজেলার বিভিন্নস্থানে অর্ধশতাধিক চুল্লি রয়েছে। এছাড়া পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী ও কয়রা উপজেলার নাকশাসহ অন্যান্যস্থানে শতাধিক চুল্লি রয়েছে। জনবহুল এলাকায় গড়ে ওঠা এসব অবৈধ চুল্লি থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত কার্বন মোনোঅক্সাইড। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন চুল্লির আশেপাশে বসবাসরত বাসিন্দারা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিশু ও শ্বাসকষ্টের রোগীরা।
গতবছর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েকটি চুল্লিতে অভিযান চালায়। এসময় জরিমানা করে কিছু অবৈধ চুল্লি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তবে অভিযানের মাস না পেরোতেই ফের কাঠ পুড়াতে শুরু করে সেসব চুল্লির মালিকরা।
স্থানীয়রা জানান, যখন কাঠ পোড়ানো শুরু হয়, তখন চুল্লি থেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে থাকে। ধোঁয়ায় আশপাশের পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে সময় রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে বা ঘরে থাকলেও চোখ জ্বালাপোড়া করে, শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, রূপসার রামনগর এলাকার কসমস সী ফুডের আশপাশে শতাধিক বসতঘর। তার দক্ষিণে রূপসা নদীর তীর ঘেষে জ্বলছে বেশ কয়েকটি চুলা। মুখ বন্ধ চুলায় উঁচু হয়ে থাকা নল অবিরত উগলে দিচ্ছে কালো ধোঁয়া। চুলাগুলো পরিচালনা করছেন সোহরাব, রেখসোনা, মনির ও আফজাল মুন্সি। প্রায় তিন দশক থেকে নির্দিধায় চলছে পরিবেশ বিধ্বংসী এই কারবার।
এদিকে রহিমনগরের কাঁচাবাজার ঘেষে দীর্ঘদিন থেকে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা উৎপাদন করছে মোঃ আজিজ শেখ। বাজারের দোকান মালিক ও স্থানীয় বাসিন্দারা নানা সমস্যায় ভুগলেও প্রভাবশালী আজিজের ভয়ে মুখ খোলেনা কেউ।
রহিমনগরের বৌ-বাজারের অদূরেই কয়লার চুলা চালাচ্ছে ডাক বিভাগের সরকারী কর্মচারী কামরুল। গত বছরের জুনমাসে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে দুটি চুলা ভেঙে দেয়। তবে মাস না ঘুরতেই নতুন চুল্লি তৈরী করে শুরু হয় কয়লা তৈরী।
রামনগর নতুন বাজার খেয়াঘাটের পূর্বপাড়ে অবৈধ চুল্লির ব্যবসা চালাচ্ছে মোশাররফ হোসেন মুসা। আইচগাতী ইউনিয়নের শিরগাতী এলাকার স্লুইসগেটের পাশে সিংহেরচর এলাকার বাবু ও আল-আমিন চালাচ্ছে ৫টি অবৈধ চুল্লি। ঘাটভোগ ইউনিয়নের আলাইপুর এলাকায়ও গাছ পুড়িয়ে কয়লা তৈরী করছে একটি প্রভাবশালী চক্র।
পাইকগাছার চাঁদখালী বাজার থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী কয়রার নাকশা এলাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অন্তত শতাধিক চুল্লিতে প্রতিনিয়ত পুড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ ও বনজ কাঠ।
পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী ইউনিয়নে চুল্লি ব্যবসা পরিচালনায় রয়েছেন, ধামরাইলের আইয়ুব ও তার পার্টনার, ফতেপুরের জিল্লু ও তার পার্টনার। চাঁদখালী বাজার সংলগ্ন এলাকা থেকে শুরু করে রাস্তার ধারে সারিবদ্ধভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ চুল্লি পরিচালনায় রয়েছেন জনৈক মিন্টু, মিঠু, দিপু, জিয়া, লাচু, হাবিব, ইউপি সদস্য খোকন, সাঈদ, শাহাদাতসহ আরও অনেকে। পাইকগাছার চাঁদখালীর সীমান্তবর্তী কয়রা উপজেলায় নকশা এলাকার চুল্লি পরিচালনা করছেন জনৈক মোঃ ইকরামিনসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন।
সরেজমিনে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, নদীর পাড়, প্রধান সড়ক ও জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসব চুল্লি স্থাপনে ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা। কারখানার পাশ দিয়ে চলাচল করতে পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসরত অনেকেই জানান, ইতোমধ্যে তারা শ্বাসকষ্টসহ বায়ুদূষিত নানা সমস্যায় ভূগছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মণ পর্যন্ত কাঠের যোগান দিতে হয়। সে হিসেবে দেড় শতাধিক চুল্লিতে প্রতিবার কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ হাজার মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এক প্রকার অবাধে এ চুল্লির ব্যবসা পরিচালনা করছেন। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন বাধা না থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।
প্রভাবশালীদের ভয়ে এসকল অবৈধ পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন না এলাকাবাসী। তারা সকল অবৈধ কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্ববান জানিয়েছেন।
খুলনা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবু সাঈদ বলেন, কয়লার চুল্লিগুলোতে একদিকে কাঠ পোড়ানোয় পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার জরিমানা ও উচ্ছেদ করা হয়েছে। উচ্ছেদ করার কিছুদিনের মধ্যে তারা আবার চুল্লি চালু করে। পাইকগাছার চাঁদখালীর একটি চুল্লি ৩ বার উচ্ছেদ করেছি। শুনেছি আবারও চালু করা হয়েছে। আমাদের জনবল কম থাকায় লুকোচুরি খেলার সুযোগ পাচ্ছে তারা। অবৈধ চুল্লি বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগীতা কামনা করেন এই কর্মকর্তা।