খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

খুলনার সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তী

কাজী মোতাহার রহমান

মনিরুল হুদা। খুলনার সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আস্থার প্রতীক। খুলনার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তী। এ আমলের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। আজকের প্রজন্মের সাংবাদিকদের গর্ব ও অহংকারের অগ্রজ সহকর্মী। তিনি দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ। পাকিস্তান জামানায় এবং বাংলাদেশের পঁঞ্চাশ বছরের নানা ঘটনার প্রতক্ষদর্শী।

১৯৫২ সাল থেকে আজ অবধি সংবাদপত্র জগতে পদচারণা করছেন তিনি। এ গর্ব দক্ষিণাঞ্চলবাসীর। খুলনার সাংবাদিকতায় এক অনন্য ইতিহাস। ৬৯ বছর সংবাদকর্মী হিসেবে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ একমাত্র তিনি। দীর্ঘ সময়ে খুলনার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিল্প-কলকারখানা বিকাশ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পীর খানজাহান আলী (র.) সেতু, মেডিকেল কলেজ, বিমান বন্দর, শহর রক্ষা প্রকল্প, মংলা বন্দর আধুনিকায়ন, সর্বপরি সুন্দরবনকে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে তিনি ধীমান সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করেছেন। তার নানামূখী প্রতিভা লক্ষ্যণীয়। তিনি ভাষা সৈনিক, সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক নেতা, আয়কর আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।

বৃটিশ জানামায় বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মরহুম সামছুল হুদা তার পিতা। তিনি মহাক‚মা প্রশাসক ছিলেন। মরহুমা আমেনা খাতুন তার মা। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ১৯৫২ সালে বাগেরহাটে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। একই বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় বাগেরহাট থেকে ডাকযোগে সংবাদ পাঠাতেন। খন্ডকালীন সংবাদদাতা হলেও মূলতঃ সেই থেকে তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় বাগেরহাট থেকে মাসিক বিদ্যুৎ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। আট সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার্থে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলে বাগেরহাটে বিদ্যুতের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর পশুর নদীর জয়মনির গোলে ‘সিটি অব লিয়ন্স’ নামের বিদেশী জাহাজ নোঙ্গর করার মধ্য দিয়ে চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষের যাত্রা শুরু হয়। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজটির ছবি তিনিই ক্যামেরাবন্দি করেন। তখন তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পিতা বাগেরহাট মহাক‚মা প্রশাসকের সঙ্গে বন্দরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এ ছবিটি বন্দর কর্তৃপক্ষের ইয়ার বুকে ছাপা হয়। এটি তার জীবনের একটা বড় অর্জন।

১৯৫৩ সালে বাগেরহাট টাউন হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৫৭ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কোন বিশেষ মতাদর্শ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন।

১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশের প্রথম দিন থেকে ১৯৯৭ সালে দৈনিক বাংলা বিলুপ্ত পর্যন্ত খুলনা প্রতিনিধি হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। এ পত্রিকার ইতিহাসে তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করেন। ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারী থেকে দৈনিক জন্মভ‚মির প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শিপইয়ার্ড এলাকা থেকে একটি জঙ্গি মিছিল হাজি মহসিন রোডের দিকে আসে। এ রোডের মাঝামাঝি স্থানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও খুলনা পৌরসভার প্রশাসক সৈয়দ আফজাল কাহুতের সরকারি বাসভবনের সামনে পুলিশের গুলিতে এবং আইয়ুব খান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী খান-এ সবুরের বাসভবনের সামনে ইপিআরের গুলিতে লন্ড্রী শ্রমিক হাদিসুর রহমান, কটন মিলের শ্রমিক আলতাফ হোসেন ও রূপসা স্কুলের শিক্ষার্থী প্রদীপ মিস্ত্রী নিহত হয়। সহকর্মী আশরাফ উদ্দিন মকবুল ও আবু সাদেকের সাথে হাজি মহসিন রোডে দাঁড়িয়ে তিনি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। প্রেস টেলিগ্রাম করে সংবাদটি দৈনিক পাকিস্তান কার্যালয়ে পাঠান। পরের দিন বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়।

১৯৭১ সালের মার্চে তার নিজের বন্দুক ও পিস্তলের গুলি হাজি মহসিন রোডের অধিবাসি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। তার বাসভবনের অদুরে ছিল সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার অফিস। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল অষ্টম খন্ডে দৈনিক বাংলায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী, ১২ ফেব্রুয়ারী ও ১৫ ফেব্রুয়ারী “খুলনায় পাকবাহিনীর নরধেমযজ্ঞ” একই শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। পাক বাহিনীর নির্যাতনের খবরে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা হতভম্ব হয়ে পড়েন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সমরেন্দ্রনাথ গোস্বামী রচিত ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান নামক গ্রন্থে ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি স্থান পায়। তার লেখা স্মরণীয় সংবাদের শিরোনাম “ঘুষের বদলে জুতো”। যা ১৯৬৬ সালে দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হয়। খুলনা শহরের মুন্সিপাড়ার এক অধিবাসীর কাছে কালেক্টরেটের কেরানী ঘুষ দাবি করে। মুন্সিপাড়ার এ অধিবাসী ঘুষ দাবি করার অপরাধে কেরানীকে জুতোপেটা করে।

১৯৯০-৯১ সালে খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি জে. এইচ এম এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে খুলনা পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান মনোনীত হন। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য খুলনা পৌরসভার শতবর্ষ অনুষ্ঠানে সম্মানিত হন। এছাড়া কেসিসির মেয়র পদক লাভ করেন। খুলনা প্রেসক্লাবের রজত জয়ন্তী অনুষ্ঠানে ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের কাছ থেকে সাংবাদিকতায় ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পদক, প্রেসক্লাবের আজীবন সম্মাননা পদক, রূমা স্মৃতি পদক, খুলনা ক্লাবের প্রবীন অগ্রপথিক পদক লাভ করেন। খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২০০৮ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সেরা করদাতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালে আয়কর আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৬-২০১৯ বাংলাদেশ ট্যাক্সস ল’ইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮৫ সালের ৯ অক্টোবর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সাংবাদিক পরিষদের আহবায়ক মনোনীত হন। তার নেতৃত্বে স্থানীয় সাংবাদিকরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জে. মো. আইয়ুব খান, পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেত্রী মিস ফাতেমা জিন্নাহ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জে. এম এ জি ওসমানী, মাদার তেরেসা, সাবেক প্রেসিডেন্ট জে. জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রেসিডেন্ট জে. এইচ এম এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জে. মানেক শ’ ও এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-এর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কদের খুলনা সফরের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়।

১৯৯১ সাল পরবর্তী বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সমন্বয় সংগ্রাম কমিটি ১৮ দফা দাবি নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ কমিটির ২৯ সদস্য প্রতিনিধি দলের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি খুলনাবাসীর পক্ষ থেকে রূপসা নদীর ওপর সেতু, বিমানবন্দর, ওয়াসা, মোংলা বন্দরের ড্রেজিং, শহর রক্ষা প্রকল্প ও খুলনা-মাওয়া সড়ক প্রশস্তকরণের দাবি উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী রূপসা নদীর ওপর সেতু, খুলনা-মাওয়া সড়ক প্রশস্তকরণ ও মোংলাবন্দর ড্রেজিং-এর বিষয়টি প্রাধান্য দেন।

তিনি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, তাইওয়ান, নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকা সফর করেন। ১৯৮৪ সালে পবিত্র হজ্ব পালন করেন।

তার পরিবার ১৯৫৩ সালে খুলনায় আসেন। ১৯৬৫ সাল থেকে হাজি মহসিন রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তিন কন্যা ও এক পুত্রের জনক। কর আইনজীবী পেশার পাশাপাশি ২০০৬ সাল থেকে তিনি দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। আজকের শুভ জন্মদিনে তার দীর্ঘায়ু প্রত্যাশা করি। তিনি মেধা ও শ্রম দিয়ে খুলনাবাসীর আরও কল্যাণে আসুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

খুলনা গেজেট /এমএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!