ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত স্থাপনা বিখ্যাত মুসলিম শাসক খানজাহান (রহ) এর বসত ভিটা খননে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) দিনব্যাপি বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের সুন্দরঘোনা গ্রামে বসত ভিটার ডিবিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আয়োজনে এই প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
সকালে প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান। এসময় বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া তাসনিম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনার আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন, সহকারী পরিচালক মোঃ গোলাম ফেরদৌস, ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আখতারুজ্জামান বাচ্চু, বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান মোহাম্মাদ যায়েদ, আল আমীন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ফিল্ড অফিসার মোসাঃ আইরীন পারভীন, মোঃ হাসানুজ্জামানসহ স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে প্রত্নবস্তুর প্রদর্শনী খবরে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খানজাহান (রহ) এর বসত ভিটায় ভীড় জমান। খননে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন দেখে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাগমাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌসুমি আক্তার বলেন, খানজাহান আলী (রহ) ও ষাটগম্বুজ মসজিদের বিষয়ে বইতে পড়েছি। আজ এখানে এসে স্বচোক্ষে বসত ভিটা দেখলাম। বসতভিটা খননে প্রাপ্ত খানজাহান আমলের বিভিন্ন তৈজষপত্র, পাথর ও নিত্য প্রয়োজনীয় পন্য দেখে আমাদের খুব ভাল লাগছে।
ষাটগম্বুজ খানজাহানিয়া-জব্বারিয়া আদর্শ আলিম মাদরাসার সহকারি শিক্ষক ওজায়ের সরকার বলেন, প্রত্নবস্তুর প্রদর্শনী দেখানোর জন্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে এখানে এসেছি। অনেক পুরোনো জিনিষপত্র দেখলাম। খানজাহানের এই বসত ভিটার সাথে বাগেরহাট জেলা প্রতিষ্ঠার অনেক ইতিহাস জড়িত রয়েছে। বাগেরহাটকে জানতে হলে খানজাহানকে জানার আহ্বান জানান এই শিক্ষক।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভভি ইয়াসমিন বলেন, ‘খান জাহানের বসতভিটা হিসেবে সংরক্ষিত এই প্রত্নস্থলটিতে বেশ কয়েকবার খনন করা হয়েছে। এবারের খননে প্রাচীন দেয়াল, মেঝে, পয়োনিষ্কাশন প্রণালির নালা, পোড়ামাটির তৈরি পাইপসহ বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শন প্রদীপদানি, পোড়ামাটির পুঁতি, লাল, কালো ও ধূসর বর্ণের মৃৎমাত্র, প্লেট, গ্লাস, পিরিচ, নল, জালের গুটি, টাইলস, অলংকৃত ইটসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে। এই প্রদর্শনী শেষে প্রত্নবস্তুগুলো বাগেরহাট যাদুঘরে সংরক্ষন করা হবে। পরবর্তীতে এই গবেষনাপত্র প্রকাশেরও ইচ্ছে পোষন করেন বিভাগীয় এই কর্মকর্তা।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পৃথিবীর প্রাচীন শহরের মধ্যে খলিফাতাবাদ অন্যতম। যা কালের বিবর্তনে বাগেরহাট নাম ধারণ করেছে। বাগেরহাটের ইতিহাস, ঐহিত্য অনেক প্রাচীন ও সম্মৃদ্ধ। প্রত্মসম্পদে ভরপুর এই জেলা। এই জেলাকে পর্যটকদের জন্য আরও বেশি আকর্ষনীয় করতে প্রত্মসম্পদ বিষয়ে গবেষনা বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান জেলার এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানায়, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের গেল ৯ ফেব্রুয়ারি খানজাহান (রহ) এর বসত ভিটা খনন শুরু হয়। এই খনন কাজে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের ১০জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অংশগ্রহণ করেন। এদের পাশাপশি খনন কাজে দক্ষ শ্রমিকরাও অংশ নিবেন এই খনন কাজে। ৪০ দিনের এই খননে বিভিন্ন ইমারতে দেয়াল ও সংযোগ দেয়াল, পাকা মেঝে, প্রাচীন রাস্তার ধ্বংসাবশেষ, ইটের নির্মিত পাকা ড্রেন, বিভিন্ন যুগের ইটের সলিং, তৈল প্রদীপ, আয়রন নেইল, টাইলস, টেরোকোটা সম্মৃদ্ধ পাত্র, মাটির তৈরি স্প্রিং কলার, মাটির তৈরি পানি নির্গমন নল পাওয়া গেছে। খননে প্রাপ্ত এসব প্রত্নবস্তু পরবর্তীতে যাদুঘরে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক লাভভি ইয়াসমিন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে খানজাহান (রহ) এর নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদসহ ১৭টি স্থাপনাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা এলাকায় অবস্থিত খানজাহান (রহ) এর বসত ভিটা অন্যতম। ষাটগম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র ৩০০ মিটার উত্তরে এই বসত ভিটাটি রয়েছে। ২০০১ সালে এখানে প্রথমবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এরপর ২০০৮ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২ বারের খননে ঢিবিটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সাড়ে ৬০০ বছর আগের উলুঘ খান জাহান (হজরত খানজাহান (রহ.) আমলের নানান স্থাপনা ও ইট বিছানো সড়ক ছাড়াও আগে ও পরের বিভিন্ন যুগের স্থাপনা এবং বসতির নিদর্শন রয়েছে।
এখানে পাওয়া স্থাপত্য, মৃৎপাত্র, নানা তৈজস ও উপকরণ থেকে ধারণা করা যায়, সেই সময়ে এখানে বসবাসকারীদের একটি উন্নত রুচিবোধ ছিল। নির্মাণশৈলী ও শৈল্পিকতায় তার প্রকাশ পেয়েছে। খান জাহানের বসতভিটা বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম এক নিদর্শন, যার পাশে এখন টিকে আছে প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর আগে নির্মিত ইটের তৈরি প্রাচীন রাস্তা। খান জাহানের বসতভিটা ছাড়াও স্থানটি মধ্যযুগের অন্যতম টাঁকশাল নগরী খলিফাতাবাদ শহরের অংশ হিসেবে পরিচিত।