খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে শোলমারি নদী। এর স্রোত ও গভীরতা নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত আছে শোলমারি গ্রামের মানুষের মাঝে। নদী দিয়ে চলাচল করা লঞ্চের রোমাঞ্চকর স্মৃতি এখনও হাতড়ে বেড়ায় মানুষ। এর সবই এখন অতীত।
খরস্রোতা নদীটি প্রাণ হারিয়েছে আরও আগে। গত দুই বছর ধরে চলছে মুমূর্ষ অবস্থা। এক সময়কার ১৫০ মিটার প্রশস্ত নদীটি এখন পরিণত হয়েছে ৩-৪ মিটারের সরু নালায়। ভাটায় সেখানে নৌকা চালানো যায় না। মানুষ হেটেই নদী পার হন।
নদীটি বাঁচাতে ইতোপূর্বে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নদী দখল করে গড়ে ওঠা ইটভাটাসহ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য নোটিশও দেওয়া হয়েছে। জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় আলোচনাও হয়েছে কয়েকবার। এরপর থমকে গেছে সব আয়োজন। দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবহেলায় দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার পূর্ণ যৌবনা খরস্রোতা শোলমারি।
নদীর মৃত্যু দেখে আফসোসের শেষ নেই এলাকার মানুষের। একটু যারা সচেতন, তারা বলছেন নদীটি বাঁচানো না গেলে ভবিষ্যতে আরও খারাপ দিন অপেক্ষা করছে। কারণ ডুমুরিয়া উপজেলার বিল ডাকাতিয়া, গুটুদিয়া পঞ্চু এবং বটিয়াঘাটার জলমা ইউনিয়নের পানি শোলমারি নদী দিয়েই নিষ্কাশন হয়। নদী না থাকলে ভবিষ্যতে ওই এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা রয়েছে।
আর বটিয়াঘাটার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, চলতি বছর অনাবৃষ্টির মধ্যে একমাত্র বটিয়াঘাটা উপজেলাতেই লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ শোলমারি নদী এবং ভেতরের খালগুলো। বিশেষ করে ধান, তরমুজ ও তিল চাষের জন্য শোলমারি নদী ও খালের পানি ব্যবহার হয়। নদী না থাকলে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের কৃষিতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নথিতে শোলমারি নদীর দৈর্ঘ্য দেওয়া আছে ২৯ কিলোমিটার। প্রস্থ ১৫০ মিটার, গড় গভীরতা ১২ দশমিক ৭৫ মিটার। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার কাজীবাছা নদী থেকে শোলমারি নদীর উৎপত্তি। বিল ডাকাতিয়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমবাহী হয়ে ডুমুরিয়ার গুটুদিয়া ও পঞ্চুর মধ্য দিয়ে এটি সালতা নদীর সঙ্গে মিশেছে। এরপর পুনরায় জলমার নিকট কাজীবাছা নদীতে ফেরত এসেছে।
শনিবার সকালে নদীর শোলমারি খেয়াঘাট এলাকায় গিয়ে খরস্রোতা নদীর করুণ দৃশ্য দেখা গেছে। বিশাল নদীটি সরু নালার মতো প্রবাহিত হয়ে কোনোরকম অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। নদীর দুই পাশে জেগেছে বিশাল চর। সেখানে চলছে দখলের উৎসব। নদী দখল করে তৈরি করা ইটভাটাগুলো আগের মতোই রয়েছে। ওপারে নতুন আরেকটি ভাটা তৈরি হয়েছে।
ঘাটে দাড়িয়েই কথা হয় কৃষক আবদুল জব্বার সানার সঙ্গে। তিনি জানান, ১০/১২ বছর আগেও নদীতে বড় বড় নৌকা, লঞ্চ চলতো। স্রোতের কারণে মালবাহী নৌকা ঠিকমতো চলতো না। তখন কৃষকদের দিয়ে গুণ টানানো হতো। বর্তমান ঘাটও ছিলো নদীর ভেতরে। এখানেও ৬০/৭০ হাত পানি ছিলো।
কথা বলতে বলতে দেখা গেল, ওপার থেকে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে নদী দিকে হেটে আসছেন এক যুবক। দিব্যি হেটেই নদী পার হলেন। মাঝনদীতে তখন হাটু পানি।
এগিয়ে যেতে নিজের পরিচয় দিলেন পূর্ণানন্দ। বটিয়াঘাটা সদর ইউনিয়নের পাথরিঘাটা গ্রামে তার বাড়ি। জানালেন, পৈত্রিকভাবে মাছের ব্যবসা করেন। আগে প্রতিদিন সকালে নৌকায় করে নদী পার হতেন। গত দুই বছর ভাটার সময় নৌকা চলে না। তখন হেটেই নদী পার হন।
নদীর তীরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ধরে (পোল্ডার ২৮/২) ভ্যানে যেতে পুরোটা পথই নদীর হতশ্রী দশা দেখা গেল। উত্তর শোলমারি দক্ষিণপাড়া এলাকায় নদীর চর দখল করে বালু ভরতে দেখা গেল। হোগলবুনিয়া খেয়াঘাটে দেখা গেল কাটাতারের বেড়া দিয়ে নদী ঘিরতে।
সঙ্গে থাকা ভ্যান চালক আবদুর রহিম জানালেন, গতবছরও এই জায়গা ফাঁকা ছিলো। এখন যে যেভাবে পারছে নদীর চর দখল করে নিচ্ছে। সামনের বছর এলাকায় আসলে নদীর পাশে কোনো জায়গাই ফাঁকা পাবেন না।
নদীর তীর ধরে উত্তর শোলমারি গ্রামে গিয়ে দেখা হলো মতিয়ার রহমানের সঙ্গে। ২০০৮ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অবসর নিয়ে গ্রামেই থাকছেন। তিনি বলেন, সত্তরের দশকে ২৮/২ পোল্ডারটি তাদের হাতেই তৈরি। নদীটি সব সময় খরস্রোতা ছিলো। নদীর দুই মাথা থেকে অতিমাত্রায় পলি আসা, নদী দখল করে ইটভাটা, চর দখল হয়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে মরতে বসেছে। তিনি বলেন, বিল ডাকাতিয়াসহ ৭/৮টি পোল্ডারের পানি শোলমারি নদী দিয়ে নামে। নদী না বাঁচালে এই এলাকায় মানুষ থাকতে পারবে না।
নদীর রামদিয়া স্লুইচগেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ৯টি গেটের ৮টিই বন্ধ হয়ে গেছে। একটি গেট দিয়ে কোনো রকম রামদিয়া খালের পানি নামছে। স্থানীয়রা জানান, ঠিকমতো পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতের বৃষ্টিতে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে গিয়েছিলো।
শোলমারি নদী পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা বিভাগ-১ এর আওতায়। দপ্তরটির নির্বাহী প্রকৌশলী নতুন যোগ দিয়েছেন। আগের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম দায়িত্ব পালন করছেন বিভাগ-২ এ। সার্বিক বিষয় নিয়ে তিনি বলেন, শোলমারি নদী খননের বিষয়টি বিবেচনায় আছে। কবে নাগাদ খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে, তা তিনি জানাতে পারেননি।
খুলনা গেজেট/ টি আই