খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৫শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকাতে পোপের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

কৃষক আত্মহত্যার দায় কার?

গৌরাঙ্গ নন্দী

বাংলাদেশের বয়স অর্ধ-শতক পেরিয়েছে বেশ আগেই। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছি বলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। একথা ঠিক যে, আমাদের অর্থনীতির আকার এখন অনেক বড়। দেশে কয়েকশ’ জন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। কর্পোরেট পুঁজি বেশ শক্তিশালী। অনেক বড় বড় অট্টালিকা হয়েছে। রাস্তা-ঘাট অনেক বড়। গড় আয়/আয়ুও বেশ উঁচুতে। এসবের বিপরীতে বেকারের সংখ্যাও অনেক বেশী। কাজের সুযোগ একেবারে কম। সনদধারীরা কাজ পাচ্ছে না। বেকার-ছদ্ম-বেকার সমাজ-সরকারের সবচেয়ে বেশী মাথা-ব্যথার কারণ। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানও বেড়েছে, বাড়ছে। তবে এরমধ্যে সবচেয়ে খারাপ যে গোষ্ঠী তা হচ্ছে, কৃষক সম্প্রদায়। মাঠে-ঘাটে কাজ করে যারা ফসল ফলায় তারা ফসলের দাম পায় না। লাভ ত দূরের কথা; বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের উৎপাদন খরচও ওঠে না। বিস্ময়কর হচ্ছে, ফসল যখন ওঠে, তখন দাম কম। ফড়িয়া, আড়তদাররা সস্তায়, একেবারে কম দামে কৃষক তথা উৎপাদনকারীর নিকট হতে পণ্য কিনে জমা করার পরেই বাজারে সেই পণ্যের দাম তিনগুণ, চারগুণ বেড়ে যায়। এবছরেও তাই হয়েছে, পেঁয়াজ চাষী দাম পায়নি; আলু চাষী দাম পাচ্ছে না; তরমুজ চাষী দাম পাচ্ছে না। উৎপাদনকারীরা দাম না পেলে ত ভোক্তার কাছে তা কম মূল্যে পাওয়ার কথা, কিন্তু তা হচ্ছে না, ভোক্তাকে সেই গলাকাটা দামেই কিনতে হচ্ছে। আর দাম না পেয়ে হতাশা-দেনা-একরাশ উপায়হীনতার সাথে লড়াই করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়া কৃষক নিজেকে হত্যা করছে, আত্মহত্যা করছে; আত্মহত্যাকারীদের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে।

চলতি বছর দুই জন কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা আমরা পত্রিকায় দেখেছি। একটি ঘটনা ঘটেছে মেহেরপুরের মুজিবনগরে; অন্য ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীতে। মেহেরপুরে কৃষক সাইফুল শেখ ক্ষেতেই বিষপান (কীটনাশক) করেন; আর রাজশাহীর কৃষক ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কেউ কেউ মেহেরপুরের কৃষক সাইফুল হককে মানসিক রোগী বলার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, আত্মহত্যাকারী কৃষক সাইফুলের মেয়েকে সাংবাদিকরা মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, তাঁর বাবা মানসিক চাপে ছিলেন। এই মানসিক চাপের বিষয়টি মানসিক রোগী হিসেবে কোথাও কোথাও বর্ণিত হয়েছে। অবশ্য, আমাদের সমাজে প্রকৃত তথ্য চেপে যাওয়া বা দায়িত্বশীলদের পক্ষ হতে প্রকৃত বিষয়টির অস্বীকৃতি বা স্বীকার না করার একটি চর্চা আছে; কারণ, স্বীকার করলে যে দায়ও নিতে হয়।

ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী দেশীয়দের কোন বিষয়ে তাদের দায় নিতেন না; এক ধরণের অস্বীকৃতি জানানোর একটি চর্চা ছিল। ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করে স্বাধীন হয়েছি বটে, কিন্তু আমরা কোন ঘটনাকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে শিখিনি; অথবা শাসকের দম্ভ বজায় রাখার জন্যে শাসিত বা দরিদ্র নাগরিকের অধিকার স্বীকার করতে শিখিনি।

মুজিবনগর উপজেলার ভবরচর গ্রামের দরিদ্র কৃষক সাইফুল শেখ (৫৫) গত ২৫ মার্চ তার ক্ষেতে থাকাবস্থায় বিষপান করে। সেই বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি ২৭ মার্চ মারা যান। ২৫ মার্চ শেষ বিকেলে তিনি বাড়ি ফিরে এলে পরিবারের সদস্যরা টের পান তিনি বিষ পান করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বমি করছিলেন, বমি’র গন্ধে তার মা জানতে চাইলে তিনি বলেন তিনি ক্ষেতে কচু গাছে ব্যবহার করা বিষ পান করেছেন। এর কয়েকদিন আগে থেকেই উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম না পেয়ে তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। ওইদিনও তিনি সকালে ক্ষেতে গিয়েছিলেন। দুপুরের দিকে বা তার পরে তিনি বিষ পান করেন। বিকেলে যখন তিনি বাড়ি ফেরেন তখন তিনি বিষের প্রতিক্রিয়ায় কাহিল হয়ে পড়েন। তাকে প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়; সেখান থেকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। কুষ্টিয়ায় তিনি ২৭ মার্চ বেলা দশটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

ভবরপাড়ার ঘটনা নিয়ে সংশ্লিষদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, সাইফুল শেখ উৎপাদিত পেঁয়াজের দাম না পাওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন; ব্যক্তিগতভাবে দেনাও ছিলেন, দেনা কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন; এরই এক পর্যায়ে তিনি ক্ষেতে থাকাবস্থায় বিষ পান করেন। বিষ পানের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। দরিদ্র কৃষক সাইফুলের দেনাদার (এনজিও’র নিকট হতে ঋণ, সার ও কীটনাশকের দোকানে দেনা এবং নিত্য-প্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে ধারে পণ্য কেনা বাবদ দেনা) ছাড়া অন্য কোন শত্রু বা বিরোধ আছে, এমন কোন বিষয় বা ঘটনার কথা জানা যায়নি। দরিদ্র এই কৃষক পরিবারটির কৃষিকাজই আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়া বাড়িতে তাঁরা অন্যের কিনে দেওয়া ছাগল পালন (বড়ো) করেন। প্রতিটি বয়সী ছাগল বিক্রি করা অর্থ থেকে ছাগলের ক্রয়মূল্য বাদ দিয়ে যে টাকা পাওয়া যায় তার দুই ভাগের এক ভাগ এই পরিবারটি পান।

দরিদ্র এই কৃষক পরিবারটির বসতভিটা মাত্র ৫ (পাঁচ) কাঠা জমির উপর। চাষের জমি আছে মাত্র এক বিঘা। আরও এক বিঘা জমি ভাড়ায় নিয়ে (বছরে ২৫/৩০ হাজার টাকা) তিনি এই বছর দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন। এবারে পেঁয়াজ চাষে উৎপাদন খরচ পড়ে প্রতি বিঘা নিজের জমিতে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা; ভাড়ার জমি হলে এক লাখ হতে এক লাখ ৫ হাজার টাকা। সাইফুল শেখ জমি ভাড়ায় নিয়েছিল বলে তাঁর উৎপাদন খরচ বেশী পড়ে। তিনি জমি কতো টাকায় ভাড়ায় নিয়েছিলেন তা পরিবারের সদস্যরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। একইভাবে তিনি কতো টাকা দেনা ছিলেন তাও তাঁরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন এই সাইফুল শেখ। তাঁর মৃত্যুতে প্রকৃতপক্ষে, তিনজন নারী সদস্যের এই পরিবারটি একেবারে উপায়হীন অথৈ সাগরে পড়েছে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ নারী সদস্য হচ্ছেন সাইফুল শেখের মা, তাঁর বয়স আনুমানিক ৭৫ বছর; সাইফুল শেখের স্ত্রী (৫০) প্রতিবন্ধী এবং কন্যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কুষ্টিয়া কলেজে মাস্টার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি টিউশনি করে তার খরচ জোগাড় করতেন। এখন পিতার মৃত্যুতে তিনি বাড়িতে মা ও দাদীকে দেখাশোনা করার জন্য অবস্থান করছেন। তাঁর মা প্রতিবন্ধী এবং দাদী বয়স্ক ভাতা পান। সাইফুল শেখের জমি তাঁর পিতার নামে। সেই হিসেবে এই জমি উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি এবং তাঁর চার বোনের মালিকানা রয়েছে।

ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে, সরকারিভাবে এই ঘটনাটিকে পেয়াঁজের দাম না পাওয়ায় কৃষকের আত্মহত্যা বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি) এই বিষয়টির অনুসন্ধানে একটি তথ্যানুসন্ধানকারী দল পাঠায়। যে দলটি ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় মুজিবনগর উপজেলার ইউএনও’র সাথে সাক্ষাৎ করে। ১৭ এপ্রিল ইউএনও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তাসহ সাইফুল শেখের বাড়িতে যান। ইউএনও পরিবারের তিন জন নারী সদস্যের সাথে কথা বলেন। পরিবারটিকে তাৎক্ষণিক ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা নগদ সহায়তা করেন। পরিবারটির দেনা পরিশোধের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সাইফুল শেখের কন্যার লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তার আশ্বাস দেন। পরিবারটি যাতে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা পেতে পারে সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে অঙ্গীকার করেন।

সাইফুল শেখের মৃত্যুর ঘটনায় মুজিবনগর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের হয়েছে। তবে সাইফুল শেখের মরদেহ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন হয়েছে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, পরিবারের পক্ষ থেকে ময়না তদন্ত না করার দাবি জানানো হয়েছিল। সাইফুল শেখের মেয়ে লিখিত আবেদন করেছে বলা হলেও তার মেয়ে এই ধরনের কোন আবেদন করেননি বলে দাবি করেছেন।

প্রকৃপক্ষে, কৃষক যাতে উৎপাদিত ফসলের লাভজনক মূল্য পেতে পারে সেই বিষয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত। নীতি প্রণয়ন করা উচিত। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করা উচিত। পেঁয়াজ ছাড়াও যেকোন কৃষি পণ্য ক্ষেত থেকে ওঠার সময় একেবারেই মূল্য কমে যায়, সেই ফসল ফড়িয়া হয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে এর মূল্য তিনগুণ থেকে চারগুণ বা তার বেশী বেড়ে যায়; ভোক্তা পর্যায়ে অনেক বেশী দামেই সেই পণ্য বিক্রি হয়। একদিকে উৎপাদনকারী কৃষক তার উৎপাদনমূল্য পায় না; অন্যদিকে ভোক্তারও বেশী দামে পণ্য কিনতে হয়; মাঝখানে মুনাফা লোটে ফড়িয়া, আড়তদার, পাইকার। ফলে পণ্য উৎপাদনের পূর্বাভাস, বাজারজাতকরণের ধরণ, ফসল উৎপাদন প্রভৃতি সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়ার দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।

আত্মহত্যাকারী সাইফুল শেখের কন্যা রোজেফা খাতুন ২৩ এপ্রিল ঢাকায় সাংবাদিকদের নিকট বলেছেন, ‘আমার আব্বা এনজিও এবং সারের দোকান থেকে ঋণ নিয়া পেঁয়াজ চাষ করছিল। দুই বিঘা জমিতে চাষ করতে খরচ হইছে দেড় লাখ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে পাইছে মাত্র ৫৮ হাজার টাকা। ঋণ শোধের চিন্তায় আব্বা পেঁয়াজ ক্ষেতেই বিষপানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলো। আব্বা পেঁয়াজ বিক্রি করছিল ৬০০ টাকা মণ। অথচ এহন বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি অয় দুই হাজার টাকায়। কারণ, এখন কৃষকের ঘরে পেঁয়াজ নাই। আমার আব্বার মত কৃষকরা যদি এভাবে ঠইকা আত্মহত্যা করে, তাইলে দেশের মানুষরে মুখে খাবার তুইলা দিব কারা?’ আমাদের কাছে কী রোজেফা খাতুনের এই প্রশ্নের জবাব আছে??

খুলনা; এপ্রিল ২৫, ২০২৫




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!