কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বিষিয়ে উঠছে সুন্দরবন। হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবন উপকূলের প্রাণ বৈচিত্র্য। একইভাবে লোকালয়েও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে ইচ্ছেমত। ফলে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সাথে নির্মূল হচ্ছে ফসলের জন্য উপকারী পোকামাকড়ও। আর এজন্য কীটনাশক ব্যবহারে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, অনেক কীটনাশক নিষিদ্ধ করা হলেও তার ব্যবহার যেমন থেমে নেই, তেমনি কীটনাশক আমদানির ক্ষেত্রেও নেই কোনো বিধিনিষেধ বা তদারকি। একইভাবে সুন্দরবনের নদীতে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরার ক্ষেত্রে অসাধু জেলেদের যেমন অপতৎপরতা রয়েছে, তেমনি কীটনাশক ব্যবহারে লোকালয় কৃষক পর্যায়ে সচেতনতারও যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবে সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরা রোধে যেমন বনবিভাগের তৎপরতা অব্যাহত আছে, তেমনি কৃষক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে তৎপর রয়েছে কৃষি বিভাগ। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো কীটনাশক আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে নেই কোনো প্রশাসনিক তদারকি।
সূত্র মতে, পরিবেশ সংরক্ষণ ও মৎস্য প্রজনন মৌসুম হওয়ায় জুন থেকে আগস্ট মাস অবধি সুন্দরবনে জেলে-বাওয়ালী এমনকি পর্যটকদের প্রবেশও নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু এই সময়ে অসাধু জেলেরা বনবিভাগের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে মাছ ধরে। এসময় অধিক মাছ শিকারের আশায় তারা নদীতে বিষ (কীটনাশক) প্রয়োগ করে। এতে সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালের মৎস্য সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়ছে প্রাণ-বৈচিত্র্য।
সুন্দরবনের নদী খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরার অভিযোগে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনকর্মীরা ২০২২ সালে ৪টি নৌকাসহ ১২ জন জেলেকে আটক করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ৫ বোতল বিষ, ২টি অবৈধ ভেসালি জাল ও ২টা কল জাল জব্দ করা হয়। একইভাবে ২০২৩ সালের চলতি মাস পর্যন্ত একই অভিযোগে ৬টি নৌকাসহ ৮ জনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১০ বোতল বিষ, ৪টি অবৈধ ভেসালি জাল ও ২টি কলজাল জব্দ করা হয়। তারপরও থেমে নেই বিষ দিয়ে মাছ ধরার মতো জঘন্য অপরাধ।
এদিকে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শ্যামনগরের কীটনাশকের দোকানগুলোতে দেদারছে বিক্রি করা হচ্ছে অলড্রিন, ডায়েলড্রিন, ক্লোরডেন, এনড্রিন, হেপ্টাক্লোর, ডিডিটি, মিরেক্স, টক্সাফিন, পিসিবি, হেক্সাক্লোরোবেনজিন, ডাইওক্সিন ও ফিউরান নামের মারাত্মক ক্ষতিকর কীটনাশক। শ্যামনগরে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কীটনাশক আমদানি করা হয়। যা কৃষি কাজ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এজন্য কীটনাশকের অপব্যবহারও বাড়ছে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট কৃষি আবাদি জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৫৩৯ হেক্টর। এসব জমিতে চাষাবাদের জন্য কী পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োজন তার কোনো হিসাব নেই ওই অফিসে। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ১২জন পাইকারী কীটনাশক ডিলার ও ২২১ জন খুচরা বিক্রেতা আছে। তারা কী পরিমাণ কীটনাশক আমদানি বা বিক্রি করেন সে তথ্যও নেই তাদের কাছে। ফলে খোলাবাজারে কোনো প্রকার তদারকি ছাড়াই কীটনাশক বিক্রির কারণে এর অপব্যবহার বাড়ছে। ফলে হুমকিতে রয়েছে সুন্দরবন উপকূলের প্রাণ বৈচিত্র্য।
স্থানীয় জেলে মোঃ আব্দুল আলিম ও আব্দুল মজিদ গাজী জানান, সুন্দরবনের খাল ও নদ-নদীতে আগে অন্তত ১৭৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ৫০ প্রজাতির মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। সুন্দরবনের যে খালে কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরা হয় সে খালে ১৫-২০ দিনে কোন মাছ বা প্রাণী চোখে পড়ে না। একই সাথে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার পরে কীটনাশক দেওয়া পানির মাছ খেয়ে অনেক বন্যপ্রাণীরও মৃত্যু ঘটছে। এভাবে মারা যাওয়া বন্যপ্রাণী পরের জোয়ারে নদীতে ভাসতে দেখা যায়।
পরিবেশকর্মী অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, স্থানীয়ভাবে কীটনাশকের দোকানগুলোতে প্রশাসনিক নজরদারি না বাড়ালে সুন্দরবনে কীটনাশক ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে না। প্রশাসনিক নজরদারি না থাকায় অবৈধভাবে কীটনাশক ব্যবহারে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি অফিসার নাজমুল হুদা জানান, জমির পরিমাণ হিসাব করে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ নির্ধারণ করার তেমন কোনো প্রচলিত পদ্ধতি নেই। তবে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ কীটনাশক কোন ডিলার বা বিক্রেতা বিক্রি করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। কোন কোন কীটনাশকে প্রাণিকুলের ক্ষতি হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব কীটনাশকেই প্রাণীর ক্ষতি হয়। এটা ব্যবহারের মাত্রার উপর নির্ভর করে।
পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) কে এম ইকবাল হোসেন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনে কীটনাশক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ইতিমধ্যে বনকর্মীরা অভিযান চালিয়ে সুন্দরবনের নদী খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগে বেশ কয়েকজন জেলেকে আটক করেছে। সুন্দরবনে যে কোন ধরনের অপতৎপরতা রোধে আমাদের বনকর্মীরা সব সময় সজাগ রয়েছে। তবে প্রশাসনিক নজরদারি বৃদ্ধি করলে কীটনাশকের এমন অপব্যবহার সহজেই রোধ করা যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
খুলনা গেজেট/এনএম