খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ পৌষ, ১৪৩১ | ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  গাজীপুরে কারখানায় আগুন : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২
  হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম তদন্তে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৬৫

কাঁদালে তুমি মোরে ভালবাসারই ঘায়ে

এ এম কামরুল ইসলাম

আমাদের সোম ভাই। জনাব মোঃ গজনফর আলী জোয়ার্দার ওরফে সোম।

এলাকার সকলের কাছে তিনি সোম নামে পরিচিত ছিলেন। মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল একটু ভিন্নভাবে। কারো কাছে তিনি ছিলেন তদ্বিরকারী (নিজের জন্য নয়, এলাকার জন্য) , কারো কাছে পরোপকারী, কারো কাছে এলাকার উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। তিনি কখনোই কারো ক্ষতির কথা চিন্তা করতেন না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত বা আদর্শগত শত্রুর সাথেও তিনি কখনো বিরোধে জড়াতেন না। তাঁর এলাকার উন্নয়নে চরম বিরোধী পক্ষের সাথে আপোষ করতে কখনো পিছপা হতেন না।

সাধারণত এইসব আদর্শ মানুষেরা আজকালকার সমাজে তেমন বেশি মূল্যায়িত হন না। সোম ভাইও তাঁর জীবদ্দশায় সঠিকভাবে মূল্যায়িত না হলেও জীবনের শেষ দিনে সবাইকে কাঁদিয়ে তাঁর পাওনা বুঝে পেয়েছেন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি বেশ কিছুদিন বাড়িতে ও হাসাপাতালে ছিলেন। বাড়িতে থাকা অবস্থায় তাঁর অসুস্থতার কথা লোকজন তেমন জানতে না পারায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে তিনি হাসপাতালে আইসিইউ-তে থাকা অবস্থায় তাঁর সু্যোগ্য সন্তান অধ্যাপক মামুন কাদের তাঁর ফেসবুকে বাবার জন্য দোয়া চেয়ে একটি পোস্ট দেওয়ায় অনেক মানুষ সোম ভাইয়ের অসুস্থতার কথা জানতে পারে। মূহুর্তের মধ্যে দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ তাঁর জন্য দোয়া করতে থাকেন। আল্লাহর অশেষ কৃপায় তিনি অল্প সময়ে সকলকে কাঁদিয়ে জীবনের চরম সত্য মেনে নিয়ে চলে গেলেন। তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মধুগ্রামে। অর্থাৎ তাঁর নিজ গ্রামে। এই জানাজায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জ্ঞানীগুনি মানুষ শরিক হয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আমার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এই মহান মানুষটির জানাজায় শরিক হয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন থেকে বঞ্চিত হই। তবে দূর থেকে তাঁর অসুস্থতার সময় স্নেহের মামুন কাদেরের মাধ্যমে মোটামুটি খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি।

মৃত্যুর পরপরই ফেসবুকের কল্যাণে সাথে সাথে খবর পেয়ে মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। কিন্তু তাঁর সন্তানদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় মামুন কাদেরকে ফোন করে সমবেদনা জানাতে গিয়ে ফোন হাতেও নিয়ে বার বার থেমে গেছি। কারণ কোন শোকাহত মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কখনোই আমার মুখ থেকে ভালমতো বের হতে চায় না। কেন জানি মনে হয়ে, আমি মিথ্যে সান্ত্বনা দিচ্ছি বা আমি নিজের সাথে নিজে প্রতারণা করছি। অথবা একজন শোকাহত মানুষকে তার শোকের কথা মনে করিয়ে দিয়ে পুনরায় আঘাত করছি। আমাদের দেশের মানুষের কাছে আমার এসব ধারণা ভ্রান্ত মনে হতে পারে। কারণ আমরা শোকাবহ মানুষ বা শোকাবহ পরিবারের সাথে শোকের আলোচনা করায় অভ্যস্ত হয়ে আছি। কিন্তু আমার জানামতে বিভিন্ন উন্নত দেশে একজনের কষ্টের কথা সহজে আর একজন সাধারণত মনে করিয়ে দেয় না।

এমনকি নিজের কষ্টের কথা অন্যকে জানাতেও দ্বিধাবোধ করে। তাইতো সেসব দেশে অধিকাংশ মানুষ তার অতি পরিচিত বা কাছের মানুষ মারা গেলেও পাশাপাশি বসবাস করেও অনেক সময় জানতে পারে না। আমি নিজে বাংলাদেশের বসবাস করেও কারো মৃত্যু সংবাদে তার পরিবারের শোকাহত সদস্যদের সমবেদনা প্রকাশ করতে কম অভ্যস্ত। এসব অভ্যাসগত সীমাবদ্ধতার কারণে সোম ভায়ের মৃত্যুর সংবাদ ফেসবুকের মাধ্যমে জেনেও স্নেহের মামুনকে অহেতুক কষ্ট দিতে সমবেদনা জানাতে চাইনি। কিন্তু স্নেহের মামুন নিজেই একসময় আমাকে খবরটি জানাতে ভুল করেনি। সুতরাং আমি আরো একবার সোম ভাইয়ের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

আজকাল আমাদের দেশে অনেকেই এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করে থাকেন। তাদের প্রায় প্রত্যেকের কাজের পিছনে কোন না কোন ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকে। কিন্তু আমাদের সোম ভাই এলাকার উন্নয়নে সারা জীবন যত কাজ করেছেন তার পিছনে কোন ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত ছিল না। ছোটখাটো একটা সরকারি চাকরি করে যে সামান্য টাকা উপার্জন করতেন তার একটা মোটা অংশ এলাকার উন্নয়নের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে খরচ করতেন। সোম ভাইয়ের একটা হোন্ডা -৫০ মোটরসাইকেল ছিল। সেই মোটরসাইকেল নিয়ে তিনি বিভিন্ন অফিস আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতেন। তাঁর সাথে থাকতো বিভিন্ন কাগজপত্র। কোন তদ্বিরে ঢাকায় যাওয়ার দরকার হলে নিজের গাটের টাকা খরচ করে সেখানে চলে যেতেন। নিজের টাকায় ঢাকায় হোটেলে থেকে খেয়ে না খেয়ে কাজ উদ্ধার করে আনতেন। কিন্তু কখনো কারো কাছে হাত পাততেন না। অর্থাৎ যাকে বলে – গাটের খেয়ে বনের মোষ কিলানো।

এলাকার উন্নয়নে সোম ভাইয়ের কাজের হিসাব দিতে গেলে তাঁর সফলতা যেমন রয়েছে, তেমনি ব্যর্থতাও আছে। সফলতার উদাহরণ হিসেবে অনেক কিছু উল্লেখ করা যায়। আমি এখানে দুই একটি জানা অজানা ঘটনা তুলে ধরছি।

সরকারি শাহপুর মধুগ্রাম কলেজের সামনের জায়গাটা ডাকবাংলোর মোড় নামে পরিচিত। সেই ছোটবেলা থেকে এই ডাকবাংলোর মোড় শুধু নামই শুনি, কিন্তু কোন ডাকবাংলো দেখতাম না। তবে বৃটিশ আমলে এখানে ডাকবাংলো ঠিকই ছিল। আমাদের সোম ভাই এই মধুগ্রামের ঐতিহ্য ‘ডাকবাংলা’ নামটি পুনরুদ্ধারের জন্য সেই জায়গায় ডাকবাংলো নির্মাণের ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ও পরিশ্রমের ফলস্বরূপ মধুগ্রামের সেই পুরনো ঐতিহ্য ডাকবাংলো এখন এলাকার শোভা বর্ধন করছে। গ্রামের মধ্যে এমন সুন্দর ডাকবাংলো আজকাল তেমন চোখে পড়ে না।

আর একটা উদাহরণ না দিলেই নয়। এই ঘটনা অধিকাংশ মানুষ জানে না। কিন্তু আমি তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এই ঘটনাটি সবাইকে জানিয়ে আমি কিছুটা দায়মুক্ত হতে চাই।

আমি তখন খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি ডিবি হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সোম ভাইয়ের ছেলে স্নেহের মামুন কাদের তখন সরকারি বিএল কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। একদিন বিএল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জনাব জাহিদ হোসেন, মামুনসহ কয়েকজন শিক্ষক ও আমি একসাথে নোয়াপাড়া কলেজ, ভবদহ কলেজ ভ্রমণের উদ্দেশ্য বের হয়েছিলাম। দিন তারিখ ঠিক মনে নেই। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর বেলায় মামুনের গ্রামের বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার জন্য কিছু সময় অবস্থান করতে হলো। প্রচন্ড গরমে সোম ভাইয়ের আপ্যায়ন মনে রাখার মতো ছিল। খাবার শেষে এক পর্যায়ে আমরা গাছতলায় বসে ঠান্ডা হাওয়া খুঁজছিলাম। এমন সময় সোম ভাই নিজে না খেয়ে একটা তালপাখা দিয়ে প্রিন্সিপাল জাহিদ সাহেবের গায়ে বাতাস করতে লাগলেন। একজন মুরুব্বি মানুষের হাতে বাতাস খেতে প্রিন্সিপাল সাহেব মোটেই স্বস্তিবোধ করছিলেন না। তাই তিনি সর্বোচ্চ আপত্তি করতে লাগলেন। কিন্তু সোম ভাই বাতাস করেই চললেন। এক পর্যায়ে তিনি বাতাস থামাতে বাধ্য হয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের সামনে বসে পড়লেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন- আমার একটা আর্জি ছিল স্যার।

আমরা সবাই মনে করলাম – তিনি হয়তো মামুনের জন্য কোন তদ্বির করবেন। কিন্তু না। তিনি আস্তে আস্তে তাঁর সেই বিনীত ভঙ্গিতে বললেন – বিএল কলেজের বাস শাহপুর পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রীদের নিতে আসে। কিন্তু এই বাস যদি শোলগাতিয়া বাজার পর্যন্ত যায় তাহলে যশোর জেলাসহ এই এলাকার আরো ছাত্র ছাত্রী উপকৃত হবে। কিন্তু রাস্তা বাড়বে মাত্র চার/ পাঁচ কিলোমিটার।

প্রিন্সিপাল জাহিদ সাহেব তাঁর কথা শুনে কালবিলম্ব না করে বাস সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ফোন করে পরদিন থেকে শোলগাতিয়া বাজার পর্যন্ত বিএল কলেজের বাস চলাচলের নির্দেশ দিলেন। আমরা সকলেই বিস্মিত হলাম। এই হলো আমাদের প্রিয় সোম ভাই।

তাঁর উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। সাথে সাথে তাঁর ব্যর্থতার অনেক তথ্য উপস্থাপন করা যাবে। তিনি যেসব পদক্ষেপে ব্যার্থ হয়েছেন তার প্রত্যেকটি ছিল এলাকার জন্য উন্নয়নমূলক। কথায় বলে- হাজারো অকল্যাণমূলক বড় বড় সার্থক উদ্যোগের চেয়ে, যেকোন ছোট অথচ কল্যাণমূলক ব্যর্থ চিন্তাও অনেক মহৎ।

সোম ভাই তাঁর অনেক ব্যর্থ অথচ কল্যাণমূলক চিন্তা রেখে চিরাচরিত নিয়মে পরপারে চলে গেছেন। তাঁর সেইসব অসমাপ্ত কাজগুলো বিবেচনায় নিয়ে এলাকার সক্ষম মানুষেরা যদি এগিয়ে এসে বাস্তবায়ন করেন তাহলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসীব করুক। আমীন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, সোনামুখ পরিবার। (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, অব.)




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!