খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬
  গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে ৩ শিক্ষার্থী নিহত

কাঁচা মরিচের মূল্য বৃদ্ধি : সামাজিক সমস্যা না সংকট?

ড. খ. ম. রেজাউল করিম

বিভিন্ন ধরনের সমস্যা বাংলাদেশের সমাজ জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলেছে। এসব সমস্যার অধিকাংশ মোকাবিলায় তাৎক্ষনিক কার্যকর তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে একদিকে পুরাতন সমস্যাগুলো যেমন জটিলরূপ ধারন করে, তেমনি নব নব সমস্যার উদ্ভব ঘটে। সাম্প্রতিক দেশের এমন একটি সামাজিক সমস্যা হলো বাজারে কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি। কোনো সমাজের অধিকাংশ জনগণের মধ্যে যদি এমন ধারণা জন্মে যে, সমাজে এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যা সমাজকে অস্থির ও অসুস্থ করে তুলেছে তখন কোন সামাজিক সমস্যা রয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। অর্থাৎ সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি পরিস্থিতিকে বুঝায় যা অবাঞ্চিত এবং যার প্রতিকার সংঘবদ্ধভাবে করা উচিৎ। সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে ৪টি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। যথা- (ক) সামাজিক সমস্যা সমাজের এক বিশেষ পরিস্থিতি, (খ) সমাজের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর দ্বারা আক্রান্ত, (গ) সামাজিক মূল্যবোধের বিচারে এটি অনাকাঙ্খিত এবং (ঘ) সমাজের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস যৌথ প্রচেষ্টায় এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কাঁচা মরিচের মূল্যবৃদ্ধি সাম্প্রতিক বাংলাদেশে অন্যতম সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা যায়।

আবার মানব সমাজ উন্নত এবং অপরিবর্তনীয় বলে মনে হতে পারে, তবে বাস্তবে, যে কোনো হুমকি হাজির হতে পারে। কিছু সভ্যতা সামাজিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং ফলস্বরূপ তা ভেঙে পড়েছে। সামাজিক সংকটের সংজ্ঞায় বলা হয় সামাজিক সংকট হলো যখন সমাজের মৌলিক কাঠামো কোনো কারণে বাধার বা পতনের সম্মুখীন হয়। এই সংকটগুলি যুদ্ধ, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা, অর্থনৈতিক ব্যর্থতা, বন্যা এবং হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে যেকোনো কিছু হতে পারে। সেই বিচারে বাজারে কাঁচা মরিচের মূল্য বৃদ্ধি একটি সামাজিক সংকট। পার্থক্য বিচারে সামাজিক সংকটের চেয়ে সামাজিক সমস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি স্থায়ী। এই বিবেচনায় কাঁচা মরিচের মূল্য বৃদ্ধি একটি সাময়িক সামাজিক সংকট।

সাম্প্রতিক দেশে আলোচিত সামাজিক সংকট কাঁচা মরিচের মূল্য বৃদ্ধি। কাঁচামরিচ দেশের অন্যতম কৃষিজাত পণ্য। কাঁচা মরিচ ছাড়া অনেক বাঙালির ভোজই হয় না। এই মরিচ ভিটামিনের এক চমৎকার উৎস। রয়েছে নানা পুষ্টিগুণও। হিসেব অনুযায়ী আধা কাপ পরিমাণ কুচি কাঁচা মরিচে প্রায় ৮০০ ইউনিটের বেশি ভিটামিন এ রয়েছে।

জানা যায়, এই মরিচের আদি নিবাস আমেরিকা মহাদেশে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্র রান্না ও ঔষধি হিসাবে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রায় ৭৫০০ বছর আগে থেকেই আমেরিকার আদিবাসীরা মরিচ ব্যবহার করে আসছে। ইকুয়েডর-এর দক্ষিণ পশ্চিমাংশে পুরাতাত্ত্বিকেরা ৬০০০ বছর আগে মরিচ চাষের প্রমাণ পেয়েছেন। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে মরিচের চাষ করা হতো প্রাচীনকাল থেকেই। ইউরোপীয়দের মধ্যে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ক্যারিবীয দ্বীপপুঞ্জে মরিচের দেখা পান।মূলত কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকেই মরিচ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।দিয়াগো আলভারেজচানকা নামের একজন চিকিৎসক কলম্বাসের দ্বিতীয় অভিযানকালে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ হতে স্পেনে মরিচ নিয়ে আসেন। তিনি ১৪৯৪ সালে মরিচের ঔষধী গুণাগুণ নিয়ে প্রবন্ধ লিখেন। স্পেনীয় ব্যবসায়ীরা মেক্সিকো থেকে মরিচ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়ে আসে। প্রথমে ফিলিপাইনস এবং তার থেকে ভারতবর্ষ, চীন, কোরিয়া ও জাপানে মরিচ বিস্তার লাভ করে। ঝাল ও স্বাদের জন্য অচিরেই এটি এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় খাবারের অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হয়।

বর্তমান পৃথিবীর ৪৪ শতাংশ মরিচ চীন দেশে উৎপন্ন হয়। অবশ্য সবচেয়ে বেশি মরিচ উৎপাদনের কৃতিত্ব ভারতের। গবেষকরা বলেন, বেশ কয়েকটি পথে চীন দেশে মরিচ প্রবেশ করেছিল। এর মধ্যে জনপ্রিয় মত হলো, প্রাচীন বাংলা থেকে মিয়ানমার হয়ে দক্ষিণ চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ঢুকেছে। এই প্রদেশের ঝাল খাবার চীনের জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত।অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে একদা চীনে রঅবিসংবাদী নেতা মাও সে-তুং বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, নো চিলি, নো রেভল্যুশন। অর্থাৎ মরিচ ছাড়া কোনো বিপ্লব হবে না।

জানা যায়, পর্তুগিজরা প্রথম কাঁচামরিচ ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়ে আসে। তারা সেটা পেয়েছিল মেক্সিকো থেকে। পর্তুগিজরা মরিচ নিয়ে প্রথমে হাজির হয় ভারতের পশ্চিম উপকূলে। সেখান থেকে তাদের হাতেই কাঁচামরিচ আসে পূর্ব উপকূলে, তারপরে অবিভক্ত বাংলায়। বাংলা থেকে মিয়ানমার, তথা বার্মা হয়ে মরিচ হাজির হয় চীন ও থাইল্যান্ডে। পর্তুগিজ জাহাজ মরিচ নিয়ে হাজির হয় ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায়।

ধারণা করা হয়, ভারতের পশ্চিম উপকূলের কালিকট বন্দরে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামার জাহাজের নাবিকদের মাধ্যমেই ভারতীয় উপমহাদেশে মরিচ ছড়িয়ে পরে।মজার বিষয় হলো মরিচ কিন্তু প্রথমে খাবার হিসেবে পর্তুগিজরা বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়নি। পর্তুগিজ পাদরিরা সেগুলো বাগানে রোপণ করে বাগানের শোভাবর্ধন করত। সবুজ মরিচ গাছের সাদা সাদা ছোটফুল, সেইফুল থেকে হওয়া লাল মরিচ হয়তো তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। তবে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ সেটাকে খাওয়ার বুদ্ধি বের করে। ফলে এখন এদেশের মানুষ ভুগছে মাঝেমাঝেই বেশি দামে মরিচ কিনে। দাম যাই হোক, রান্নাঘরে মরিচ না থাকলে একদিনও চলে না।

মরিচ ছাড়া আরো কিছু উপাদান আছে, যা খাবারে ঝাল স্বাদ আনতে পারে। যেমন- গোলমরিচ। গোলমরিচ নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। যেমন- আজ থেকে চারশ বছর আগে এক মুঠো গোলমরিচ থাকলে তখনকার লন্ডন বা আমস্টারডাম শহরে কিনতে পারা যেত একটি বাড়ি। এমনও শোনা যায় যে ইউরোপের কোনো কোনো দেশের রাজা নাকি আধ মুঠো গোলমরিচ হাতে ধরিয়ে দিয়ে জেনারেলদের বলত, এই দিলাম তোমাদের বেতন, এবার যাও! সোনার চেয়েও দামি ছিল এ বস্তু। প্রাচীন বাংলায় তো বটেই ইউরোপেও গোলমরিচ ছিল ঝালের অন্যতম প্রধান উপাদান। গোলমরিচের ঝাল বেশ অদ্ভুত। জিবের চেয়ে ঠোঁটেই এর ঝাল অধিক অনুভূত হয়। কাঁচামরিচের মতো হঠাৎ করেই অবাক করে না গোলমরিচের ঝাল। আবার নাগা মরিচের মতোও নয় তার ঝালের পরিমাণ। গোলমরিচ দেওয়া খাবার খেলে তার ঝাল বোঝা যায় ধীরে ধীরে। যেভাবেই বলিনা কেন গোলমরিচের গুঁড়া ইউরোপের খাবারে এখনো এক আভিজাত্যের নাম। গোলমরিচের মতোই খুব মৃদু ঝালের মসলা লবঙ্গ। খাবারে মৃদু ঝাল স্বাদ আনতে লবঙ্গ ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশের সব জেলাতেই মরিচের চাষ হয়। তবে বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নাটোর ও যশোর জেলায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয়। কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে কাঁচামরিচের চাহিদা ১৫ লাখ টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১.৬০ লাখ হেক্টর জমিতে ১৪.৫৩৫ লাখ টন মরিচ উৎপাদন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছিল ১৪.৯২ লাখ টন। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে মোট ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৭ কৃষক বাণিজ্যিকভাবে মরিচ উৎপাদন করে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের বাইরে কৃষকের আনাচে-কানাচে নিজেদের খাওয়ার জন্যে যে মরিচ উৎপাদিত হয় তা বাণিজ্যিকভাবে মরিচ উৎপাদনে প্রযুক্ত জমির সমান বলে ধরে নেয়া যায়। এই হিসাবে সারাদেশে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫১৪ একর জমিতে মরিচ উৎপাদিত হয় বলে ধারণা করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে প্রযুক্ত সকল জমির শতকরা প্রায় ২৬ ভাগ ঢাকা বিভাগে, শতকরা ১৯ ভাগ চট্টগ্রাম বিভাগে, শতকরা ১৮ ভাগ রাজশাহী বিভাগে এবং শতকরা ১৮ ভাগ রংপুর বিভাগে অবস্থিত। মরিচ চাষে প্রযুক্ত সকল জমির সবচেয়ে কম-শতকরা ২ ভাগ সিলেটে। দেশে মরিচ সাধারণত শীত ও গ্রীষ্মকাল উভয় মৌসুমেই উৎপাদিত হয়। মরিচের শীতকালীন উৎপাদন গ্রীষ্মকালীন উৎপাদন থেকে অধিকতর বিস্তৃত।

সম্প্রতি দেশে মরিচের মূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে মরিচ সংকটের পিছনে নানা কারণ রয়েছে। যেমন, এ বছর আবহাওয়ার কারণে মরিচের উৎপাদন কম হয়েছে। তাছাড়া বছরের এই সময়টায়, অর্থাৎ বর্ষার মৌসুমে কাঁচামরিচের দাম এমনিতেই বেড়ে যায়। পাশাপাশি দেশের বাজারের অস্থিতিশীলতা বা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কোনো দায় থাকতে পারে, যা আমরা ইতোপূর্বে পেয়াজের ক্ষেত্রেও লক্ষ করেছি। আবার ঈদের ছুটিতে পরিবহন সংকটের কারণে দাম বেড়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তবে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের দাবি-টানা দুই মাস খরা, এরপর অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এই দুই কারণে কাঁচামরিচের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে চাহিদার তুলনায় বাজারে পণ্যটি কম। এজন্যই দাম বেড়ে গিয়েছে। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে সমাজের সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষের উপর। অনেকের মতে, সরকারের আশু পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ সংকটের মাত্রা অনেকখানি কমানো সম্ভব হয়েছে। ফলে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোন থেকে তাই কাঁচামরিচের মূল্য বৃদ্ধি সাম্প্রতিক দেশের অন্যতম সামাজিক সংকটে রুপ নিয়েছে।

লেখক: সমাজ গবেষক ও সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!