খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

করনাত্তোর চ্যালেঞ্জ: পরিকল্পিত অর্থনীতির রূপরেখা অতীব জরুরী

মো. নূর-উল-আলম

কভিড-১৯ এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের কারণে ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পরে বিশ্ব অর্থনীতি একটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে যার ফলে বিশ্বজুড়ে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে অপরদিকে কর্ম হারাচ্ছে মানুষ; যা আরো বাড়বে বলে সকলের আশংকা ।   বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক আপডেট বলছে, ইউক্রেনে চলমান ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ বিশ্বে উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য মহামারী পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সকল সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়েছে। তাই, উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে মন্দা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখনই তার অর্থনীতির রূপরেখা নতুন পরিকল্পনায় ঢেলে সাজাতে হবে ।

আশার কথা এই যে বিশ্ব পূর্বের পূর্বাভাসের চেয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঝড়কে ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে বলে মনে হচ্ছে । যদিও বিশ্ব উৎপাদন ২০২২ সালে একটি উল্লেখযোগ্য শতাংশে সংকুচিত হয়েছিল, কিছু কিছু বড় অর্থনীতিতে প্রত্যাশার উর্ধ্বে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে । এর কারণ ছিল  ওই দেশ সমূহের সরকারের দ্বারা মহামারী-যুগের পূর্বেই গৃহীত কিছু উদ্দীপনা কর্মসূচির বিচক্ষণ সম্প্রসারণ ।

যুদ্ধের কারণে বাণিজ্য হ্রাস , খাদ্য উৎপাদন হ্রাস , জ্বালানি মূল্য বাড়ি দেওয়ার মত উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাতের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে । ফলে বিশ্বের সবকটি অর্থনীতিই উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে । উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে তাদের সকলেরই অর্থায়নের কাঠামো ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছে । বর্তমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি সুস্পষ্ট ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে । তাই এটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যে অর্তভূক্ত করা নীতিনির্ধারকদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশে নানাবিদ কারনে আয় এবং কর্মসংস্থান এ দু’টি বিষয় শ্লথ হয়ে পড়ছে । তাই সরকারকে এসব বিষয়ে নীতি প্রনয়ণ করে মৃদু মন্দা যাতে ভয়াবহ মন্দা না ঘটায় সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পলিসি প্রনয়ণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা শুধুমাত্র ভোগ বৃদ্ধি, যার প্রধান অর্থ যোগান দাতা প্রবাসী আয় এবং তৈরী পোষাকখাতের রপ্তানি আয় , দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে তার ইপ্সিত অর্থনৈতিক মন্দা  কাটানো সম্ভব না ।  উপরন্তু , উভয়খাতে আয় এখন অনেকটা নিন্নগামী এবং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। অথচ বিনিয়োগের বিকল্প খাত তৈরী না হওয়ার  ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ বাড়ছে না ,বাড়ছে না কর্মসংস্থানও ।

‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা ’ হিসেবে যোগ হয়েছে  শিক্ষাব্যবস্থায়  বিদ্যমান প্রায় শত ভাগ পাসের হার। ফলে বাড়ছে পুঞ্জিভূত ব্যাপক বেকারত্ব। সবচেয়ে আতংকের বিষয় হলো বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষিতদের প্রায় অর্ধেকই বেকার ! আই.এল.ও’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তরুন বেকারের সংখ্যা হয় ছিল `দ্বিগুন’  । ২০২০,২০২১ এবং ২০২২ সালে তা কী হয়েছে তা সকলেরই অনুমেয়।

বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্তিক বোনাসের সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে । কেননা বাংলাদেশের প্রায় ৬৮ শতাংশ জনসংখ্যা কর্মক্ষম ! জনসংখ্যার প্রায় সত্তর ভাগ কর্মক্ষম এ ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল ঘটনা। সঠিকভাবে কাজে না লাগালে এ সুবিধাজনক অবস্থা অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দেশের বিশাল দায় হিসেবে আবির্ভূত হবে। দ্রুত ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করতে পারলে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে অচিরেই বাংলাদেশের সকল অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

এ সমস্যা থেকে উত্তোরনের সমাধান হলো  সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পলিসি তৈরী করা :        i) আয় সুরক্ষা বা  বৃদ্ধির ব্যবস্থা বিষয়ক পলিসি যেমন সুদের হার বাড়ানোসহ অপরার ব্যবস্থা এবং ii) চাকরি সুরক্ষা বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ব্যবস্থা বিষয়ক পলিসি যেমন সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা,কৃষি উৎপাদন বাড়ানো বা সম্পূর্ণ কৃষি জমি অনাবাদী না রাখা ইত্যাদি।

ব্যষ্টিক আয় বাড়লে  জাতীয় আয় বৃদ্ধির কাজটি কীভাবে হয়  বিশ্লেষন করলে বিষয়টি  বুঝতে আরো সুবিধা হবে । প্রথমেই দেখি আমরা আয় করে  আসলে কী করি । ব্যক্তি মাত্রই  আয় করে তার একটা অংশ ব্যয় বা ভোগ করেন এবং  বেঁচে যাওয়া অংশ সঞ্চয় করেন । ক্ষুদ্র  ক্ষুদ্র  সঞ্চয় তিনি বিনিয়োগ করেন । এরূপ ব্যষ্টিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র  সঞ্চয় সমষ্টিকভাবে বিশাল মূলধনের যোগান দেয়। সমষ্টিকভাবে  সকল আয়, ব্যয় তথা ভোগ, সঞ্চয়,বিনিয়োগ কিংবা উৎপাদন বৃদ্ধি চক্রাকারে  জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে  প্রভাব  ফেলে ।

অপরপক্ষে কর্মসংস্থান বাড়লে , আয় বাড়বে । আয়ের দু’টি অংশ ; ভোগ এবং অবশিষ্টাংশ সঞ্চয় । ভোগ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদন বাড়বে এবং বাড়তি উৎপাদন চাহিদা বিনিয়োগ বাড়াবে । বাড়তি বিনিয়োগ কর্মসংস্থান বাড়াবে । কেননা অর্থনীতিতে কোন একটি উপাদান বা চলকের  হ্রাস-বৃদ্ধি অপরাপর চলকগুলোর হ্রাস বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে ।

তাই অচিরেই মুদ্রাস্ফীতির সাথে মিল রেখে সুদের হার বাড়ানো উচিত । পাশা-পাশি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক পরিসেবাগুলিতে উল্লেখযোগ্য ব্যাঘাত রোধ কল্পে সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামষ্টিক দূরদর্শী  আর্থিক নীতি প্রনয়ণ করতে হবে। যেহেতু নমনীয় বিনিময় হার  অর্থনৈতিক মন্দার বাহ্যিক ধাক্কা শোষণ করার জন্য অপর্যাপ্ত ,তাই নীতিনির্ধারকদের সংকটময় পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার হস্তক্ষেপ বা মূলধন প্রবাহ ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

গবেষনায় এটি দেখা গেছে যে, স্বল্পমেয়াদে চাকরি সুরক্ষা ব্যবস্থার কারনে উচ্চতর ব্যয়, উচ্চ কর্মসংস্থান এবং কম দারিদ্র্রতা পরিলক্ষিত হয় । অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদে মন্দার সকল ধাক্কাকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলি খুব কার্যকর হয় ; যা মহামারীর সময় গৃহীত হয় এবং এই শিক্ষাগুলি নীতিনির্ধারকদের জন্য সবসময় শিক্ষামূলক । দীর্ঘমেয়াদেও বিশ্বায়ন,জনসংখ্যার প্রবণতা,প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন সহ এবং শ্রমবাজারকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলি কার্যকর বলে প্রমানিত।

ভবিষ্যতের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য নীতি নির্ধরনের মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও বিবেচনা করা  যেতে পারে (i) গ্যারান্টিযুক্ত ন্যূনতম আয় সহায়তা যা ব্যক্তি এবং পরিবারকে প্রতিকূল ধাক্কা থেকে রক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা , (ii)  বেসরকারী খাতে আনুষ্ঠানিক চাকরি সৃষ্টি  ; (iii) পিছিয়ে পড়া  এলাকা এবং জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত কভারেজ এবং সুরক্ষা ; এবং (iv) পরিসেবার ব্যবস্থার মান উন্নয়ণ এবং সেবার ডিজিটালাইজেশন।

পরিশেষে বলা চলে , ইউক্রেনে চলমান ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ’ বিশ্বে উদীয়মান অর্থনীতির হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কভিডোত্তোর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সকল সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দিয়েছে। তাই , উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে উক্ত মন্দা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে এখনই তার অর্থনীতির রূপরেখা নতুন পরিকল্পনায় ঢেলে সাজাতে হবে ।

লেখক: আইনজীবী, ই-মেইল: csnoor.bd@gmail.com




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!