খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ৪৫
  মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ

কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত ও তার কর্মকান্ড

মুজফ্ফর হোসেন, মুর্শিদাবাদ

১৯১০ সালের ১৩ জুলাই কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর জন্ম। প্রয়াত হন ১৯৮২ সালের ২৯ নভেম্বর। জন্মেছিলেন পরাধীন ভারতে, আর প্রয়াত হন রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পর। শৈশবে স্বদেশী গান শেখেন, নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন ও সাঁতার কাটতেন। বাবার বদলির চাকরি ও মায়ের অসুস্থতার কারণে ছোটবেলা থেকেই সংসারের অনেক দায়িত্ব উনাকে বহন করতে হয়। ৮ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। ডাকনাম ছিল খোকা। ভাই বোনদের তেল মাখিয়ে, স্নান করিয়ে, রান্না করে খাইয়ে তাঁকে স্কুলে যেতে হতো। এত অসুবিধার মধ্যেও তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন।

আমাদের রাজ্যে বাম আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে উনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আদর্শগত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন ও তার বিপুল জনসমর্থন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯২৪ সালে তিনি বিপ্লববাদী আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট হন, তখন তার বয়স মাত্র ১৪। ১৯২৯ সালে তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কমরেড ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ তাঁর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, “বালক বয়সেই তিনি সে সময়কার অনেক ছেলেমেয়েদের মত জীবন বিপন্ন করে বিপ্লবী অনুশীলন দলে যোগ দিয়ে ঘৃণ্য ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন–।”

১৯৩৮ সালের ঐতিহাসিক মে দিবসে তিনি পার্টি সদস্যপদ পান। আমৃত্যু তিনি সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর দীর্ঘ বৈপ্লবিক জীবনের মধ্যে তিনি ব্রিটিশ আমল ও কংগ্রেস আমলে জেলে থেকেছেন প্রায় ১৩ বছর এবং আত্মগোপন অবস্থায় থেকে কাজ করেছেন ৫ বছর। কমরেড বি টি রণদিভে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, “ইস্পাতদৃঢ় খাঁটি কমিউনিস্ট।”

কমরেড বি টি রনদিভে উনার সম্পর্কে লিখেছেন “– সাম্যবাদের দিকে ঝুকবার আগেই তিনি ধর্ম ও আধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ছিলেন। অথচ তাঁর প্রথম যুগের অনেক সহকর্মীর মধ্যেই এসব ক্রিয়াশীল ছিল। প্রথম জীবন থেকেই তিনি একজন পাকাপোক্ত নাস্তিক ছিলেন এবং প্রায়শই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন নিয়ে বড়দের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করেছেন। পার্টির অভ্যন্তরে যাঁরা গোপনে ধর্মকে মেনে চলেন বা ধর্মীয় কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য অজুহাত খাড়া করেন তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দৃঢচিত্ত মার্কসীয় বস্তুবাদী এবং মার্কসীয় বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কোনরকম বিচ্যুতি তিনি সহ্য করেননি”। আমাদের নিজেদের আয়নায় নিজেদের একবার দেখে নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

মতাদর্শগত লড়াইয়ের ক্ষেত্রে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মৃত্যুতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি শোক প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন, “যুক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম এবং মার্কসবাদ লেনিনবাদ এবং সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ এর ভিত্তিতে সি পি আই (এম) কে বিপ্লবী পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত যে ভূমিকা পালন করেন, তার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি গর্বিত। সমানতালে তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে বামপন্থী সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন, পশ্চিমবঙ্গে এই বামপন্থী সুবিধাবাদীদের অত্যন্ত বিপদজনকভাবে আবির্ভাব ঘটে এবং তারা সি পি আই (এম) কে প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে।”

সংশোধনবাদী মতাদর্শ সম্পর্কে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছেন, “সংশোধনবাদ বুর্জোয়া মতাদর্শকে মার্কসবাদের নামাবলি পরিয়ে বিভ্রান্ত করতে চায়। শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিকে এর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যেতে হয়।”

১৯৬৯ সালে একটি লেখায় কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ মনোভাবের কথা প্রকাশ করে লেখেন, “— এই হচ্ছে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা। শ্রেণী সমন্বয়, শ্রেণী- সহযোগিতার রাজনীতিতে বিশ্বাসীরাই শুধু ইন্দিরা গান্ধীকে প্রগতিশীল বলে আখ্যা দিতে পারে। একথা কখনোই ভুললে চলবে না যে, ইন্দিরা গান্ধী সেই রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, যে রাষ্ট্র হচ্ছে বৃহৎ বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত বুর্জোয়া- জমিদাররা রাষ্ট্র। ব্যাংক জাতীয়করণ, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ইন্দিরার বিদ্রোহ প্রভৃতি ঘটনায় সেই রাষ্ট্রের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।” “— কংগ্রেসের মধ্যে যারা চরম প্রতিক্রিয়াশীল সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইন্দিরা গান্ধী সাহসেরই পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাই বলে তিনি প্রগতিশীল হয়ে যাননি।”

আমাদের রাজ্যে ৬০ এর দশকের শেষ দিক ও ৭০ এর দশকে শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলন, বিশেষ করে খাস ও বেনাম জমি দখলের আন্দোলনে তিনি অন্যতম নেতৃত্ত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন। কমরেড পি সুন্দরাইয়া তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন, “আমাদের বিপ্লবী সংগ্রাম ও আমাদের দলের শক্ত ভিত হিসাবে পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে কৃষি শ্রমিক ও গরীব কৃষক নির্ভর কৃষি আন্দোলন গড়ে তোলায় আমি তাঁর উদ্যোগ এবং দৃঢতা দেখেছি।”

আমাদের শ্রেণীগত ভিত্তি, শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “শ্রেণীগত ভিত্তি ও শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অন্যান্যদের নীতি ও আদর্শের পার্থক্য না দেখিয়ে দিলে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ভিত্তিক পথের সঠিকতা প্রতিবার জোর দিয়ে না বললে, শ্রমিকশ্রেণীকে শিক্ষিত করে তোলা যায় না, বামপন্থীরা বিপ্লবী যোদ্ধায় পরিণত হতে পারে না। দেশে যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক না কেন, আর সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় পার্টিকে যে কোনো ধরনের রণকৌশলই গ্রহণ করতে হোক না কেন, পার্টিকে তার শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রতি মুহূর্তে সতর্ক এবং সজাগ থাকতে হবে। আর এখানেই পার্টির স্বতন্ত্র ভূমিকা ও স্বতন্ত্র কর্মতৎপরতার গুরুত্ব। পার্টির এই গুরু দায়িত্বের কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুললে চলবে না।”

পার্টি সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। কমরেড বি টি রনদিভে তার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, “সারা জীবনব্যাপী তিনি এমন এক সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলতে প্রয়াস করেছিলেন, যে পার্টি মার্কসবাদী লেনিনবাদী আদর্শ অনুসরণে যেমন অটল, তেমনি বুর্জোয়া- জমিদার শ্রেণিগুলির শাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত মিত্রদের একই মঞ্চে সমবেত করে বিপ্লবের অগ্রণী বাহিনী স্বরুপ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ।”

পার্টি শৃঙ্খলাকে তিনি কঠোরভাবে মেনে চলার পক্ষে ছিলেন। যে পার্টি বিপ্লবে বিশ্বাস করে, সেই পার্টিতে যদি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতি লঙ্ঘিত হয় সেই পার্টি এগোতে পারে না। কমরেড সুরজিৎ লিখেছেন, “তিনি সর্বদাই পার্টি সংগঠনের মূলনীতি- গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা মেনে চলতেন। তিনি সবসময় মতাদর্শগত সংগ্রাম এবং পার্টি সদস্যদের শিক্ষার উপর জোর দিতেন”।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট বাড়ছে। মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদশালী হচ্ছে, আর অন্যদিকে আমজনতা নিঃস্ব হচ্ছে। এই পরিস্থিতি সম্ভাবনা তৈরি করে। সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাবার মত যোগ্য হয়ে উঠতে হবে বামপন্থীদের। শোষক শ্রেণী বাঁচবার জন্য স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক পথকে বেছে নেয়। আমাদের রাজ্য ও ভারতবর্ষে আমরা তা লক্ষ্য করছি। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ” স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি এবং সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিক শক্তির কার্যকলাপের ধারা ভিন্ন হলেও এদের লক্ষ্য কিন্তু এক। তা হলো, সংগঠিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর আঘাত হানা, এই আন্দোলন দুর্বল করা। —- স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে চলবে না। এই দুটি সংগ্রাম একইসঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। গণতন্ত্রের সংগ্রাম জয়যুক্ত করতে হলে এই দুই শক্তিকে অবশ্যই পরাস্ত করতে হবে। আজকের ভারতবর্ষে ভারতীয় জনতা পার্টির হিংস্র ও সাম্প্রদায়িক চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পুঁজিপতি জমিদারদের কোন দলই গণতান্ত্রিক হতে পারে না, এমনকি প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষও হতে পারে না। তাদের শ্রেণীর চরিত্রের কারণেই এটা সম্ভব নয়।

১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল শুধুমাত্র একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়। তার পেছনে ছিল অনেক আত্মত্যাগ। ১৯৭০ সাল থেকে অনেক কমরেড এবং নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে ,অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। এককথায় রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করেই বামফ্রন্ট সরকার এসেছে। বামফ্রন্ট সরকার গঠন মানে, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নয়। কমরেড বিমান বসু লিখেছেন, ” বামফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার পরে প্রমোদ দা বারবার আলোচনা সভায় উল্লেখ করতেন আমরা কমিউনিস্টরা, বামপন্থীরা রাজ্য সরকার পরিচালনা করছি মানে এই নয়, আমরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অবস্থান করছি। আমাদের পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব এই কথা বিশ্বাস করলেও আমাদের কর্মীদের একটা অংশ, এমনকি নেতৃস্থানীয় কিছু কমরেড এই সারবস্তু উপলব্ধি করেন না।” সেই কমরেডরা ভুলে গিয়েছিলেন যে, আমাদের পার্টির মূল লক্ষ্য হলো বামফ্রন্ট সরকার নয়, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করা। বাম সরকারের শাসনকাল যত বেড়েছে, এই বোধ ততো ফিকে হয়েছে। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর ভাবনা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি।

কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত ছিলেন বামফ্রন্টের প্রথম চেয়ারম্যান। বিপথগামী বামপন্থী দলগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে বামপন্থাই বিকল্প। প্রশাসনে না থাকলেও তিনি দ্রুততার সঙ্গে সমস্যাগুলি বুঝতে পারতেন। কমরেড অশোক মিত্রের ভাষায়, ‘প্রমোদবাবু কোনওদিন মহাকরণের চৌহদ্দিতে পা রাখেননি, অথচ প্রশাসনিক সমস্যাগুলি চট করে ধরতে পারতেন’।

বামফ্রন্ট সরকারের নিশ্চয়ই অনেক দুর্বলতা ছিল। কিন্তু সাফল্যগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হবার পাঁচ বছরের কিছু বেশি সময় বাদে তিনি প্রয়াত হন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য সম্পর্কে তাঁর সঠিক উপলব্ধি ছিল। এই বিষয়ে কমরেড অশোক মিত্র লিখেছেন, ‘গ্রামাঞ্চলে উন্নতি যে ঘটছে তার একটি প্রামাণিক সংজ্ঞা প্রমোদ দাশগুপ্ত বলতেন: আগে দরিদ্র কৃষকের ঘরে এক কিলো দুই কিলো চাল সঞ্চিত থাকত না, খরার মুহূর্ত এলেই সমগ্র পরিবার নিরন্ন অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়তো। বামফ্রন্টের প্রথম পাঁচ বছরেই অবস্থার গুণগত পরিবর্তন, প্রায় প্রতিটি গ্রামে দরিদ্রতম সংসারেও পাঁচ-ছয় কিলো চাল মজুদ, সুতরাং খরার ঋতুতেও, যতদিন সরকারি সাহায্য এসে না পৌঁছচ্ছে, তাঁদের ঠিক না খেয়ে আর থাকতে হচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে অবস্থা ফেরার অন্য একটি নিরিখও উল্লেখ করতে পারি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজ্যে অন্নাভাব দেখা দিলে কাতারে-কাতারে গ্রামের মানুষ কলকাতায় এসে জড়ো হতেন, খোলা আকাশের নিচে, উদভ্রান্ত, খাদ্যের সন্ধান করতেন ইতস্তত ঘুরে-ঘুরে। বামফ্রন্ট সরকার হাল ধরার পর এই প্রবণতা বন্ধ হয়েছে, চরম খরার সময়েও গ্রামে অন্নের সংস্থান থাকছে, কলকাতায় ছুটে যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না।’ কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তর উপলব্ধ কথাগুলিও পরবর্তীকালে আমরা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর তার সুযোগে বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যম আমাদের বিরুদ্ধে লাগাতার কুৎসা করে গেছে। যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা অসহায়ের মতো মুখ বুজে থেকেছি।

বিগত ১০ বছর ধরে আমাদের রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস দল চরম জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, গুন্ডাবাজি, দুর্নীতিগ্রস্ত কাজ করেও আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছে। ১০ বছর আগে এই রাজ্যে যে বিজেপি দলের তেমন শক্তি ছিল না, এবার তারাও বিপুল সাফল্য পেলো। বামপন্থীদের বিপর্যয়কর ফলাফল হলো। ২০০৮ সাল থেকে জনসমর্থন ক্রমহ্রাসমান। বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে এই রাজ্যে। তা সত্বেও এই ফলাফল কেন? কেন আমরা গ্রাম- শহরের শ্রমজীবি মানুষ, অর্থাৎ গরিব মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম? গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। অন্যথায় ইতিহাস বামপন্থীদের ক্ষমা করবে না। কারণ ইতিহাস বড় নির্মম। প্রচার মাধ্যমকে দোষ দিয়ে, জনগণের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমরা আমাদের দায় এড়াতে পারি না। বামপন্থার রাস্তায় আমাদের ফিরে যেতে হবে।

একথা সত্য যে, তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির এক নয়। কিন্তু বিগত ১০ বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপি-র বেড়ে ওঠার উর্বর মাটি তৈরি করে দিয়েছে। এরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। মুসলিম মৌলবাদীরা তৃণমূল কংগ্রেসকে নিজেদের দল বলে প্রচার করেছে, ইমাম ভাতা-মোয়াজ্জেন ভাতা চালু করেছে, মমতা ব্যানার্জি মুসলিমদের সমস্যাগুলোর সমাধান না করে ‘মুসলিম মুসলিম’ আওয়াজ তুলে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে। কার্যত তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। বামপন্থীদের দুর্বলতা এইখানে যে, এই ষড়যন্ত্র তারা উপলব্ধি করতে পারলেও তার মোকাবিলা করতে পারেনি।

বিজেপির মত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজটা তৃণমূল করতে পারে না। কারণ এই দলটি ১৯৯৮ সালে গঠিত হবার পর থেকেই বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করে ভোটে লড়েছে, ওদের মন্ত্রিসভায় থেকেছে, আর এস এস মমতাকে দেবীদুর্গা বলেছে, মমতা আর এস এস কে দেশপ্রেমিক সংগঠন বলেছে। এগুলো সবই ইতিহাসগত ভাবে সত্য। তাই সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার গ্যারান্টি একমাত্র বামপন্থীরা। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়েই তা আমাদের বলে যেতে হবে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও একটা সরকারের হাতে কিছু টাকা থাকে- যা দিয়ে সে খানিকটা রিলিফ দিতে পারে। রিলিফ বা জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিতে খরচ করাটা কারও দয়ার দান নয়, এটা একটা অধিকার। সারাদেশে মোট যে কর আদায় হয় তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরোক্ষ কর (যা জনগণ দেয়)। জনগণের দেয় টাকার একটা ক্ষুদ্র অংশই জনগণ ফেরত পায়। যারা সব কিছু উৎপাদন করে, এই সমাজে তারাই সব কিছু থেকে বঞ্চিত। এই বঞ্চিত মানুষের চেতনা বৃদ্ধি ছাড়া কমিউনিস্টদের অগ্রগতি সম্ভব নয়। আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই চেতনা বৃদ্ধি সম্ভব- যে চেতনা পুঁজিপতি দলগুলিকে বিচ্ছিন্ন করবে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও দুর্বল করবে।

ওরা যা রিলিফ দিচ্ছে সেটা ওরা প্রচার করছে, কিন্তু যেটা ওরা কেড়ে নিচ্ছে সেটা আমরা তুলে ধরতে পারছি না। ২০১০/১১ সালে বামফ্রন্টের আমলে রাজ্যে সরকারের মোট আয় ছিল ৪৭২৬৪ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। ২০১৯/২০ সালে সেটা অনেক বেড়ে হয়েছে ১,৪২,৯১৪ কোটি ২১ লক্ষ টাকা। এটা সম্ভব হয়েছে, প্রচুর ধার করে, মদের দেদার বিক্রি বাড়িয়ে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান বৃদ্ধি থেকে। ভূমি রাজস্ব অর্থাৎ জমি থেকে নানা ধরনের কর বামফ্রন্টের আমলের তুলনায় ১২৫৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০১৯/২০ সালে ২৭২৮ কোটি ৮ লক্ষ টাকা হয়েছে। স্ট্যাম্প ও রেজিস্ট্রেশন থেকে আদায় ২২৬৫ কোটি ২১ লক্ষ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০২৫.৭৯ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বাবদ কর আদায় ৭৬৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪২১ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা। এই সমস্ত খাতে সরকারের যে আয় বেড়েছে তা সম্ভব হয়েছে জনগণের পকেট কেটে। ওরা বিপুল টাকা খরচা করে রিলিফের কাজটার প্রচার করেছে, কিন্তু ওরা যেভাবে জনসাধারণের পকেট কেটেছে সেই প্রচারকে আমরা নিয়ে যেতে পারিনি। মমতা ব্যানার্জি নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রচার করে চলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের টাকা দিচ্ছে না।

বাস্তব তথ্য কি বলছে- বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ২০১১০/১১ সালে কেন্দ্রীয় করের অংশ হিসেবে রাজ্য সরকার পেয়েছিলো ১৫,৯৫৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, আর তৃণমূল কংগ্রেসের আমলে মার্চ’২১ এ সেটা অনেক বেড়ে হয়েছে ৪৪৭৩৭ কোটি ১ লক্ষ টাকা। লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ- নিয়োগ না করে, বেকার বাড়িয়ে শত শত কোটি টাকা বাঁচানো হচ্ছে।

ঘটা করে ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প নিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। কোন কৃষকের ২ একর অর্থাৎ ৬ বিঘা জমি থাকলে তিনি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে দু’দফায় বছরে পাবেন ১০,০০০ টাকা। এই পরিমাণ জমিতে শুধুমাত্র বোরো চাষে কম করে ধান হবে ৭০ বস্তা। রাজ্য সরকার ধান কিনছে না। ফলে কৃষককে বস্তা পিছু ৪০০ টাকা কমে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি সরকারের জন্য শুধুমাত্র বোরো চাষেতেই এই কৃষকের লোকসান ২৮,০০০ টাকা। আর সরকার দিচ্ছে ১০,০০০ টাকা। অর্থাৎ সরকারের জন্য শুধুমাত্র বোরো চাষে কৃষকের ক্ষতি হচ্ছে ১৮,০০০ টাকা। বছরে অন্য চাষ ধরলে ক্ষতি আরো বেশি। মমতা ব্যানার্জির সরকার কৃষকের সর্বনাশ করে হাততালি নিচ্ছে।

আজ থেকে প্রায় ৩৮ বছর আগে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন মার্কসবাদ লেলিনবাদের ভিত্তিতে তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন। যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে তিনি পার্টিকে গড়ে তুলেছেন, সেই আদর্শকে রক্ষা করাই আজকে আমাদের কাছে প্রধান কাজ। এর জন্য প্রয়োজন পার্টির ভিতরে ধারাবাহিক ভাবে দৃঢ মতাদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তোলা। সারা বিশ্ব জুড়েই আজ বামপন্থী আন্দোলন বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। চরম দক্ষিণপন্থী বিপদের সম্ভাবনাও বাড়ছে। মধ্যপন্থার কোন স্থান নাই। বামপন্থীদের পক্ষে সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর দায়িত্ব আমাদের। ইতিহাসের সেই দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। জনগণের প্রতি আস্থা রেখেই সেই দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। কমরেড মাও সেতুং বলেছেন, “জনগণই হচ্ছেন আসল বীর। আর আমরা সব ছেলেমানুষ ও অজ্ঞ। এটা না বুঝতে পারলে সামান্যতম প্রাথমিক জ্ঞানও অর্জন করা সম্ভব নয়।”
কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত লাল সেলাম।
মার্কসবাদ লেলিনবাদ জিন্দাবাদ।
সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!