শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরদী উপজেলায় টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার উন্নতি হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় ভেসে উঠছে ধ্বংসযজ্ঞ। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে ঘর স্যাঁতসেঁতে অবস্থা ও কাদাপানিতে একাকার হয়ে থাকায় এবং চুলায় পানি ওঠায় রান্নাবান্না করতে পারছেন না তারা। এর মধ্যে অনেকের বসতঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাটের অবস্থাও খারাপ; খানাখন্দে ভরে গেছে। কোথাও এখনও পানি জমে আছে। ক্ষেতের ফসল ডুবে নষ্ট হওয়ায় আগামী দিনে কীভাবে চলবেন, সে চিন্তায় দিশেহারা কৃষক।
বুধবার নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের খলিশাকুরা গ্রামের আলিয়া খাতুন বলেন, পানি একদম নেমে যাওয়ার পর বাড়ি এসে দেখি, মেঝের মাটি নেই। ছাগল, হাঁস-মুরগি সব ভেসে গেছে।
বিধ্বস্ত ঘর মেরামত করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে হতদরিদ্র মানুষ। তাদের একজন বাঘবেড় খলিশাকুড়ি গ্রামের দিনমজুর চিন্তা হরণ বলেন, ‘বানের পানি সব ভাসাইয়া নিয়ে গেছে গা। অহন ঘরদুয়ার করার আর সামর্থ্য নাই।’
কৃষি বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, জেলার ৪৭ হাজার হেক্টর আবাদি জমির আমন ধানের ক্ষেত ডুবে গেছে। এক হাজার হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছ ভেসে গেছে ৬ হাজার ৭১টি ঘেরের।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নকিবুজ্জামান খান বলেন, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার বন্যার পানি অনেকটাই নেমে গেছে। নালিতাবাড়ী, নকলা উপজেলাসহ সদর উপজেলার প্লাবিত এলাকা থেকেও পানি ধীরে ধীরে নামছে। দু-একদিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হতে পারে।
জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না করা খাবার বিতরণ কার্যক্রম চলমান। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহে কমছে পানি
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। কিছু এলাকায় অপরিবর্তিত আছে বন্যা পরিস্থিতি। পানিবন্দি রয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। বন্যাকবলিত এলাকায় খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট রয়েছে। পানিবাহিত রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিন উপজেলাতেই প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র্যাব, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীর ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
নেত্রকোনায় বাড়ছে দুর্ভোগ
নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, সদর, বারহাট্টা ও পূর্বধলায় লক্ষাধিক মানুষ কয়েক দিন ধরে পানিবন্দি। গতকাল বৃষ্টি না হওয়ায় জেলার বিভিন্ন নদনদীর পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের খাবারের পাশাপাশি গো-খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় বাড়ছে দুর্ভোগ। উজানের পানি নিচের দিকে যাওয়ায় পাঁচ-ছয় দিন ধরে নেত্রকোনার পাঁচটি উপজেলার দুই শতাধিক গ্রামে পানি উঠেছে। এসব গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি আছেন। পানি নিচের দিকে যাওয়ায় আরও নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস জানান, বন্যাদুর্গতদের চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুকনো খাবার প্যাকেট ও নগদ টাকা দেওয়া হচ্ছে।
তিন জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত আড়াই লাখ মানুষ
ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনায় বন্যায় এ পর্যন্ত ২ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে আটজন শেরপুরের ও দু’জন ময়মনসিংহের। গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আলী রেজা।
তিনি জানান, তিন জেলার ১৩টি উপজেলা এবারের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭৩টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। মোট ৬৩ হাজার ১৭১টি পরিবার বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে মোট ১৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। মোট ১ হাজার ৩৩৭ জন সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছ ৫৬১টি গবাদি পশু। তিন জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে মোট ২০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।
গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ময়মনসিংহ বিভাগের জিঞ্জিরাম, ভুগাই-কংস ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইলেও পানি সমতলে হ্রাস পাচ্ছে। আগামী তিন দিন ময়মনসিংহ বিভাগ ও তৎসংলগ্ন উজানে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা কম থাকায় ওই তিন নদীর পানি আরও কমবে। নেত্রকোনার সোমেশ্বরী ও জামালপুর জেলার জিঞ্জিরাম নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
খুলনা গেজেট/এইচ