১৫ জুন ১৯৯৯ সাল। একটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম রাজশাহী সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজে। একটি চাকরি করতে হবে এ প্রত্যাশা নিয়ে মুলত সিদ্ধান্তটা নেওয়া।
ফুটবল প্লেয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খুলনা আগমন করেছিলাম ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৫ সালে সরকারি সুন্দরবন কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করার পর অনেকটা নিজের ইচ্ছাতে বি এ ( সম্মান) এ ভর্তি না হয়ে, বি এ পাশ কোর্সে ভর্তি হই। এই ভেবে যে পাশ কোর্সে পড়লে খেলাধুলার কোন ক্ষতি হবে না। সরকারী হাজী মুহাম্মাদ মুহসিন কলেজ থেকে ১৯৯৭ সালে বি এ (পাশ) পাশ করে সরকারি বি এল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মাস্টার্স ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করা শুরু করলাম। তখন খেলাধুলায় অনেকটা এগিয়ে গেছি আমি। তৃতীয় ও দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলের গন্ডি পেরিয়ে প্রথম বিভাগ ফুটবলে নাম লিখিয়েছি। খুলনা প্লাটিনাম জুবলি জুটমিলস ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড় আমি। কপিলমুনিতে একটি ফুটবল ম্যাচ খেলতে যাই সম্ভবত তালার সাথে আমাদের ম্যাচটি ছিল।
কপিলমুনির অনেকে সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিল। আমি মাস্টার্স পড়ছি এ কথা জানার পর আবুবকার হাজরা (আমার চাচা) আমাকে বলেছিলেন খেলাধুলা করে কি হবি জানিনা, তবে যদি রাজি থাকিস তাহলে বি পি এড করে ফেল। লুতফর স্যার ও কবির ভাইও একই কথা বললেন। সবে খেলা শুরু করেছি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। শেষমেষ ইমাম স্যার এর সরনাপন্ন হলাম। স্যার একই কথা বললেন। আর চিন্তামগ্ন না হয়ে আবেদন করলাম।
তখন ঢাকা ও রাজশাহী এই দুটি সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজ ছিল। বি পি এড করলেই চাকরির হাতছানি। জানতে পারলাম প্রায় ১৪০০ জন আবেদনপত্র জমা দিয়েছে। এস এস সি, এইচ এস সি ও বি এ মিলে নম্বরের ভিত্তিতে প্রাথমিক বাছাই করা হবে। প্রাথমিক বাছাই এ ৩০০ জনকে রাখা হলো। আমার ভর্তি রোল হলো ২৬২। ১৪ জুন ভর্তি পরীক্ষার জন্য রাজশাহী রওয়ানা হলাম। আমাকে সেদিন সবচাইতে উতসাহ দিয়েছিলেন আবুবকার হাজরা। উনি স্কূল থেকে ছুটি নিয়ে আমার সাথে রাজশাহী গেলেন। আমাদের সেদিন আলাদা আলাদা পরীক্ষা নেওয়া হলো। আমার সাথে আবুবকার হাজরা (চাচা) থাকায় আমি অনেক ভালো করেছিলাম। পরদিন ফলাফল দিলো প্রথম দিকে নাম থাকায় খুব আনন্দিত হলাম। ফিরে এলাম কপিলমুনি, রাজশাহী যেতে হবে প্রস্তুতি শুরু হলো।
২৬ জুন থেকে ৩০ জুন পযর্ন্ত ভর্তির সময়সীমা নির্ধারন করা হলো। সবার পরামর্শে ২৮ জুন রাজশাহী উপস্থিত হলাম। যেহেতু ১জুলাই থেকে প্রশিক্ষন শুরু তাই স্থায়ীভাবে থাকার মানষিকতা নিয়ে ওখানে উপস্থিত হই। কিন্তু বিড়ম্বনা হয় একজায়গায় এস এস সি থেকে বিএ পযস্ত সকল পাসের মুল সনদ সহ ভর্তি কমিটির সামনে ডাকা হলো। আমার বি এ এর মুল সনদ ওঠানো ছিলো না। আমাকে বলা হলো মুল সনদ ছাড়া ভর্তি করা যাবে না।অনেক অনুনয় বিনয় করেও কোন কাজ হলোনা। ভর্তি হতে না পেরে খুলনার ২ জন পরিচিত ছেলের কাছে আমার জামা কাপড় ব্যাগ রেখে খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। তখন বিকেল ৪টা বাজে। খুলনার ট্রেন ৩-৩০ এ ছেড়ে এসেছে। আরো বিপাকে পড়লাম। বাস পেলাম না, ভেঙ্গে ভেঙ্গে আসলাম ঈস্বরদী পযর্ন্ত। তখন লালন সেতু হয়নি। ফেরিঘাটে এসে ফেরিতে উঠতেই দেখি আমার মতো আরো ২ জন ওরা যশোর আসবে। ওখান থেকে একটি ট্রাকে করে যশোর আসলাম ওরা চলে গেলো আর আমি খুলনা আসলাম। পরদিন খুলনা হরতাল ছিল যে কারনে প্রথমে খুব হতাশ হয়েছিলাম।
পরদিন সকালে ২৯ জুন অনেক কষ্টে মুহসিন কলেজে পৌছালাম। আমার বিষয়গুলো জানার পর ঐ কলেজের অফিস সহকারী আমার কাগজপত্র গুছিযে দিলেন্। আমি ভ্যানযোগে পৌছলাম ফুলতলা এর পর ওখান থেকে যশোর মনিহার এর সামনে। ওখান থেকে ঢাকা পৌছলাম রাত ১০ টায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যিালয়ের সুর্যসেন হলে থাকতো চাচাতো ভাই আনোয়ার আল দীন (দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার) এর কাছে সব কিছু খুলে বললাম। পরদিন সকালে (৩০ জুন) ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন গাজীপুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অফিসারের কাছে। তিনি আমাকে তার গাড়ি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন। উনি আনুসাঙ্গিক কাজ শেরে খুন দ্রুত আমার সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। বেলা ১১ টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি যখন টঙ্গীব্রিজ পার হচ্ছি পাশের এক ভদ্রলোক বলাবলি করছিলেন যে,রাজশাহীর পরিবহন ধর্মঘটের কথা। কথাটা শুনে খুব দুচিন্তায় পড়ে গেলাম। তার কাছে আমার সমস্যার কথা বলায় উনি বললেন তুমি একটা কাজ করো এয়ারপোর্টে নেমে পড়ো ১২.৩০ টায় একটা বিমান যাবে রাজশাহী। আমি কাল বিলম্ব না করে এয়ারপোর্টে নেমে পড়লাম। ভিতরে যেতেই একজন এগিয়ে এসে বললেন আমি কোথায় যাবো। আমি বললাম রাজশাহী উনি আমাকে জিএমজির কাউন্টারে নিয়ে গেলেন। টিকিট পেয়ে গেলাম ১০৭০ টাকায়। টিকিট নিয়ে ভিতলে প্রবেশ করলাম।
তখন ১২.০০ টা বাজে একটু স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললাম কারন বিমান ছাড়ার সময় ছিল ১২.৩০ মিনিটে। এর আগে কখনো বিমানে ওঠার সুযোগ হয়নি। ভয় হচ্ছিল কি হয় কি হয় এই ভেবে। আমার পাশের সিটে বসে ছিলেন রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি কর্মকর্তা। উনি আমার কাছে জানতে চাইলেন কোন চাকরির ইন্টারভিউ আছে কিনা । আমি সব কথা ওনাকে বলার পর উনি বললেন কোন চিন্তা করোনা রাজশাহী নেমে আমি তোমাকে কলেজে পৌছে দেব।রাজশাহী নেমে যথারীতি উনি ওনার গাড়িতে করে রাজশাহী সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজ গেটে নামিয়ে বললেন, তোমার কোন হেল্প লাগলে বলো। আমি ওনার সাথে সালাম বিনিময় করে কলেজে প্রবেশ করলাম তখন লান্সব্রেক চলছিল। গেটের বাইরে এসে হালকা কিছু খেয়ে নিলাম।
২টা ৩০ মিনিটে কলেজ উপাধ্যক্ষ মান্নান স্যার এর কক্ষে প্রবেশ করলাম ভর্তির জন্য। আমার সার্টিফিকেট নেওয়ার ডেট ৩০ জুন। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন তুমি ঢাকা থেকে কিভাবে আসলে। উত্তরে আমি বললাম স্যার বিমানে। স্যার আমার কথায় বিচলিত হলেন বললেন,দেখি তোমার সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যাংক রশিদটা দেখাওতো। আমি ওটা দিতে স্যার আরো কয়েকজন স্যারকে ডেকে বিষয়টা দেখালেন। মান্নান স্যার সেদিন বলেছিলেন যে, তোমার ভর্তিটা স্বরনীয় করে রাখতে চাই। আমার ব্যাংক রশিদের কপি আমার আবেদন পত্রের সাথে স্টাপল করলেন। আমার জীবনে অনেক পাওয়ার মধ্যে এটা একটা বড় পাওয়া।ভর্তি হতে পেরে সেদিন যে আনন্দ পেয়েছিলাম এমন আনন্দ আগে কখনো পাইনি। প্রায় ৪৮ ঘন্টার কস্ট মুহর্তেই আনন্দের বারিধারা হয়ে নামলো। আমি ২০ বছরের শিক্ষকতার জীবনে অনেক সুনাম ও সম্মান অর্জন করেছি। যদি সেদিন রাগ করে থেমে যেতাম তাহলে আজ হয়তো নামের পাশে শিক্ষক শব্দটি লেখা হতো কিনা জানিনা। আমার এ জার্নির পেছনের কারিগরদের শ্রদ্ধা ও স্যালুট জানাই।
লেখক : ক্রীড়া শিক্ষক, বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী স্কুল এ্যান্ড কলেজ, খুলনা।
ফেসবুক ওয়াল থেকে