আচার, ব্যবহারে সাংবাদিকতায় সর্বদিক বিবেচনায় মামুন রেজা ছিল একটি ফুটন্ত গোলাপ। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৫ বছর। খুলনার সাংবাদিকতার জগতে ছোট বড় সবার প্রিয় মুখ ছিল সে। তিনবার সততা, দক্ষতা এবং যোগ্যতার সাথে খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন চ্যানেল 24 ও জাতীয় দৈনিক সমকালের খুলনা ব্যুরো প্রধান।
১৯৮০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার ব্রক্ষগাতী গ্রামে জন্ম। ওই গ্রামেই তার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। পিতার নাম কওছার সরদার। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট। ১৯৯৬ সালে দিঘলিয়া এম এ মজিদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন। গ্রামীণ জনপদ থেকে উঠে এসে অদম্য ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে খুলনার সাংবাদিকতা অঙ্গনে নিজেকে শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। খুলনার স্থানীয় দৈনিক জনবার্তায় কাজ করার মধ্য দিয়েই তার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। এরপর স্থানীয় দৈনিক জন্মভূমি, জন্মভূমি থেকে প্রকাশিত একসময়ের জনপ্রিয় সান্ধ্যকালীন রাজপথের দাবি র স্টাফ রিপোর্টার এবং যুগান্তরের খুলনা ব্যুরো প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন।
সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব এলাকার ছোট বড় সবার কাছে সে অসম্ভব প্রিয় ছিল। সদা হাসিখুশি থাকতো। কারো সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করতে দেখা যায়নি, কিংবা শোনা যায়নি। পেশাগত কারণে প্রায় দুই যুগ ধরে খুলনা শহরে বসবাস করতেন। স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্র সন্তান নিয়ে শান্তিধামের মোড়ে বসবাস করতেন। মামুন রেজার মা অনেক আগেই মারা গেছেন। গ্রামের বাড়িতে থাকেন তার বাবা এবং বড় ভাই সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা আমার সহপাঠী ছিল। সেই সুবাধে মামুনকে খুব স্নেহ করতাম। একই এলাকার এবং একই স্কুলে পড়াশুনা করেছি। সাংবাদিকতার কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক দুই’ই ভালো ছিল। শুক্রবার (২০ জুন) রাত ৯ টা ৪৭ মিনিটে খুলনা। রিপোর্টার্স গ্রুপের মেসেঞ্জারে সাংবাদিক মাহাবুবুর রহমান মুন্না মেসেজ দেয় মামুন রেজা ভাই সংকটাপন্ন অবস্থায়, সিটি মেডিকেলে আছে, সহকর্মীরা চলে আসেন। দ্বিতীয় মেসেজে লেখেন মামুন রেজা ভাই মুমূর্ষ অবস্থায় আছে, আমাকে বিমল সাহা ফোন দিয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর মামুন রেজা দীর্ঘদিনের সহকর্মী সমকালের স্টাফ রিপোর্টার হাসান হিমালয় জানান ইন্তেকাল করেছেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)।
সংবাদটি শোনার পর সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। স্নেহের মামুন রেজার অকালপ্রয়াণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ীরা। যেই তার মৃত্যুর খবর শুনছে, সেই বলছে ইস…
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিজ বাসায় অবস্থানকালে বুকে ব্যাথা অনুভূত হওয়ার পর শুক্রবার রাত ৯ টার দিকে তাকে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক রাত পৌনে ১০ টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। মামুন রেজার ছোট চাচা ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহিদ মুরাদের কাজ থেকে জানা যায় ঈদের পর মামুন স্ত্রী এবং ছেলেকে সাথে নিয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া গিয়েছিল। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে শুক্রবার সকাল ১০ টায় সে বাসায় পৌঁছায়। এরপর রাত নয়টার দিকে তার বুকে ব্যথা অনুভূত হয়।
মামুন রেজাকে খুলনা এবং তার জন্মস্থান দিঘলিয়ার মানুষ যে কি পরিমান ভালোবাসতো মৃত্যুর পরক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়া তার প্রমাণ। সোশ্যাল মিডিয়া ছেয়ে যায় মামুন রেজার ছবি আর মৃত্যুর সংবাদে।
মামুনের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয় মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে ১১ জুন সন্ধ্যায় খুলনা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। কুয়েটে নিউজ কাভারেজ করতে এসে একদিন বলল লিপু ভাই, ইউরোপের একটি দেশে ফ্যামিলিসহ যাওয়ার চেষ্টা করছি, দোয়া করবেন। কিন্তু মামুন যে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে কেইবা জানত! তার অকাল মৃত্যুতে খুলনার সাংবাদিকতার অঙ্গনে এবং তার জন্মস্থান দিঘলিয়াতে শোকের ছায়া নেমে আসে সবাইকে কান্নার সাগরে ভাসিয়ে এসে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিল।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবার প্রিয় মামুন রেজাকে জান্নাতবাসী করুন।
আমীন।
খুলনা গেজেট/এইচ