খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  আগামীর বাংলাদেশ হবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার : ড. ইউনূস
  জুলাই-আগস্টে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সময় লাগবে : উপদেষ্টা আসিফ

একজন নিঃস্বার্থ করোনাযোদ্ধার সাক্ষাৎকার

এ এম কামরুল ইসলাম

সারাবিশ্ব যখন করোনা আতঙ্কে বিপর্যস্ত, ঠিক সেই সময় একজন টগবগে যুবক করোনা বিজয়ের সর্বনাশা খেলায় নিজেকে সমর্পণ করে এখনও সুস্থ সবলভাবে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁর সাথে আমার আলাপচারিতার অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হল :

আমি : আপনার পরিচয় বলবেন প্লিজ।

আমার নাম জোনায়েদ আহসান জুনু, বয়স ২৫। বাবা হাকিম মোঃ শাহাবুদ্দিন, মা মোসাঃ সালমা বেগম। গ্রামের বাড়ি-খুলনা। থাকি- মিরপুর, ঢাকায় বাবা মায়ের সাথে। কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছি।

আমি : এই কঠিন করোনাযুদ্ধে কিভাবে এলেন?

জুনু : করোনার শুরুতে আমি ঢাকায় ছিলাম। একদিন শুনলাম আমার এক বন্ধু করোনাক্রান্ত হয়ে কুর্মিটোলা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি আছে। ভয়ে তার কাছে কেউ যাচ্ছে না। এই খবর পেয়ে আমি সেখানে ছুটে গেলাম। ঐ হাসপাতালে তখন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। তবু গার্ডদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি হাসপাতালে ঢুকে আমার বন্ধুর কাছে যাই। আমাকে দেখে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। সে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় বমি করে অস্থির। তার পাশের দু’জন রোগী ইতিমধ্যে মারা যাওয়ায় সে নিজেও মরার প্রহর গুণছিলো। আমি তার কাছে থেকে সাধ্যমত সেবা করতে লাগলাম। আশেপাশের অসহায় রুগীদেরও সেবা করতে শুরু করলাম। করোনার শুরুতে ডাক্তার ও নার্সরা ভীষণ ভীত থাকায় করোনা রোগীর কাছে তেমন কেউ যেতেন না। রোগীর আত্মীয় স্বজনও কাছে যেতো না। কিন্তু আমার বন্ধু সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি তার সাথে হাসপাতালে থেকে তাকে ও অন্যান্য রোগীদের সেবা করতে গিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে গেলাম। তারা প্রথমে আমাকে বের করে দিতে চাইলেও আমার পীড়াপীড়িতে নিজ দায়িত্বে হাসপাতালে থাকার অনুমতি দিলেন। আমি আমার সাধ্যমতো সকল করোনা রোগীকে সেবা করতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে ডাক্তার স্যারেরা আমাকে সবচেয়ে কঠিন জায়গায় কঠিন সময়ে ডিউটি দিতে শুরু করলেন। আমি রাতদিন বারো ঘন্টা ডিউটি করতে শুরু করলাম। এভাবে টানা চারমাস একদিনও ডিউটি ফাঁকি না দিয়ে কাজ করতে থাকলাম। এখন বছর পার হয়ে গেছে।

এই হাসপাতালে প্রতিদিন বারো ঘন্টা ডিউটি করার পর বাকী সময়ে অন্যান্য হাসপাতালে রোগী নেওয়া, রক্তদান, অক্সিজেন সেবাদান, অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে সহায়তা প্রদানে সম্পৃক্ত থাকতাম।

কিন্তু হঠাৎ করে হাসপাতালের সংশ্লিষ্টদের কাছে আমি আতঙ্কের কারণ হয়ে পড়লাম। আমি সারাক্ষণ করোনা রোগীদের কাছে থাকার কারণে সবাই আমার থেকে দূরে থাকতে চাইতেন। তাই কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে হাসপাতালের ভিতর আমার জন্য একটি আলাদা রুম বরাদ্দসহ তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমার কাজের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। সেই থেকে আজও করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত থাকতে পেরে আমি খুশি।

আমি : আপনার বাবা-মা কোন আপত্তি করেন না?

জুনু : প্রথম প্রথম করতেন এবং আমাকে বাসায় যাওয়া নিষিদ্ধ করেন। আমি দীর্ঘদিন বাসায় যাইনি। এখন তাঁরা মেনে নিয়েছেন। এমনকি আমি হয়তো বাসায় মায়ের সাথে রাতের খাবার খাচ্ছি, এমন সময় মোবাইলে কোন করোনা রোগীর মৃত্যুর সংবাদ এলো। তাকে গোসল ও দাফন করাতে হবে। মা তখন নিজেই বলেন, ‘রোগী যদি মহিলা হয় তবে আমাদের বাসার কাছে হলে আমি ও আমার মেয়ে সেই লাশের গোসল করাবো’।

আমি : আপনি এ পর্যন্ত কত রোগীকে সেবা করেছেন ও কত রোগী আপনার সামনে মারা গেছে?

জুনু : হাজার হাজার রোগীকে সেবা করেছি। প্রায় ৫/৬ শত মানুষের মৃতদেহ নিজ হাতে টানাটানি করেছি।

আমি : আপনার মতে বাংলাদেশের হাসপাতালে করোনাকালে চিকিৎসার মান কেমন?

জুনু : করোনার শুরুতে এই পেশায় সবাই ভয়ে ভয়ে থাকতেন। আস্তে আস্তে ভয় কমে আসছে। চিকিৎসা পদ্ধতির নতুন নতুন পথ বের হচ্ছে । আশাকরি অতি দ্রুত আরো উন্নতি হবে।

আমি : করোনা ছাড়াও আজকাল মানুষের অন্যান্য অসুখে মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। এর কারণ কি?

জুনু : আমার মনে হয় মানুষের মনে বেশি বেশি আতঙ্ক কাজ করছে। সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থায় গাফিলতির জন্য এমন হতে পারে।

আমি : আপনি নিজে কেমন সতর্ক থাকেন?

জুনু : আমি মাস্ক পরি, মাঝে মাঝে পিপিই পরি ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করি।

আমি : আপনি আপনার সেবার বিনিময়ে কোন সম্মানী নেন?

জুনু : শুরুতে আমি নিজের ইচ্ছায় কাজ করতাম। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ একটা প্রজেক্ট থেকে মাসিক সম্মানী দিতেন। এখন প্রজেক্ট বন্ধ। তবুও কাজ করি। আমার কাজের বিনিময়ে আমি কিছুই চাই না।

আমি : আপনি করোনা সেবা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত অসুস্থ হয়েছেন?

জুনু : ইনশাআল্লাহ না।

আমি : আপনি খুলনার কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চিনেন?

জুনু : জী। অনেককে চিনি। অনেক সংগঠনের সাথে কাজ করি। যেমন, খুলনা ব্লাড ব্যাংক, খুলনা অক্সিজেন ব্যাংক, সোনামুখ পরিবার।

আমি : আমরা খুলনাবাসী আপনার জন্য গর্বিত।

জুনু : ধন্যবাদ।

আমি : আপনি মৃত্যুর ভয় পান?

জুনু : মানুষের সেবার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে হয়। মৃত্যু এলে কিছুই করার নেই।

খুলনা গেজেট/ টি আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!