খুলনা, বাংলাদেশ | ৯ পৌষ, ১৪৩১ | ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  খুলনা-ঢাকা রুটে নতুন ট্রেন ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ চলাচল শুরু

এক সময়ের দ্রুততম মানবী, রেহানা পারভীনের সফলতার গল্প

একরামুল হোসেন লিপু

রেহানা পারভীন। এক সময়ের দেশসেরা এ্যাথলেট। ৯০’র দশকে বাংলাদেশের এ্যাথলেটিক্সের ট্র্যাক মাঁতিয়েছেন দাপটের সাথে। তিন বার হয়েছেন দ্রুততম মানবী। ২০২২ সালে পেয়েছেন কৃর্তিমতী ক্রীড়াবিদ সম্মাননা। ভালো কবিতা লেখেন, উপস্থাপক, উচ্চশিক্ষিত, কাস্টমসের একজন দক্ষ এবং চৌকস রাজস্ব কর্মকর্তা, সফল মা, মানবিকতায় পূর্ণ একজন মহীয়সী নারী। নিজের দুই সন্তানের পাশাপাশি ৬ এতিম বাচ্চাও তাকে মা বলে ডাকেন। যাদের যাবতীয় খরচ তিনি বহন করেন। বাংলাদেশ স্পোর্টসের ২০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিক্যাল অফিসিয়ালের মধ্যে অন্যতম একজন। রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের ন্যাশনাল স্পোর্টসের বিচারক হিসেবে দক্ষতা এবং সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকে।

রেহেনা পারভীনের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজশাহীর হরগ্রামে। পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী গার্লস হাইস্কুল, রাজশাহী মহিলা কলেজ এবং কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সংসারের বড় সন্তান । রেহেনা পারভীনের সফলতার শুরুটা হয়েছিল যখন তিনি ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। নিজ বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলো এক সময় যার কাছে ভয়ের কারণ ছিল। সেই স্কুল স্পোর্টসে অংশ নিয়ে ব্যক্তিগত কৃতিত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে শিশু একাডেমির প্রেসিডেন্ট এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে তার সফলতার গল্পের শুরুটা হয়েছিলো।

Oplus_0

যে সফলতা তাঁকে ক্রীড়াক্ষেত্রে শীর্ষে তুলে নিয়ে গিয়েছিল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশসেরা একজন এ্যাথলেট হিসেবে। তিনবার হয়েছেন দেশের দ্রুততম মানবী। অনূর্ধ্ব-১৬ (এখন যেটা জাতীয় যুব গেমস) জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। একাধিক স্বর্ণপদকসহ অসংখ্য পদক পেয়েছেন।

একান্ত আলাপচারিতায় রেহেনা পারভীন খুলনা গেজেটের এ প্রতিবেদককে বলেন, রাজশাহীতে আমার জন্ম এবং বড় হয়ে ওঠা হলেও জীবনের ভালো সময়গুলো কাটিয়েছে খুলনাতে। ছোটবেলা থেকেই স্কুল স্পোর্টসগুলো আমার কাছে খুব ভয় লাগতো। দৌঁড় শুরুর জন্য ক্রীড়া পরিচালক বাঁশিতে ফু দিলেই পরানের ভিতর ধরপর শুরু হয়ে যেত। আমি যখন ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী তখন বিথী নামে আমার এক বান্ধবীর উৎসাহ এবং জোঁড়াজুড়িতে সর্বপ্রথম রাজশাহী মিশন বালিকা বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌঁড়ে অংশগ্রহণ করি। ওই দৌঁড় প্রতিযোগিতা ফাস্ট হলাম।

সেকেন্ড থার্ড যারা হয়েছিল তারা আমার থেকে অনেক পেছনে ছিল। এরপর আমাদের স্কুলের স্পোর্টস টিচার রাজশাহী পার্কে অনুষ্ঠিত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানেও দৌঁড় প্রতিযোগিতায় ফাস্ট হলাম। এরপর তিনি আমাকে ইন্টার স্কুল খেলতে নিয়ে গেলেন।

ইন্টার স্কুলে খেললাম। সেখানেও ফার্স্ট হলাম। এরপর ন্যাশনাল স্পোর্টসে অংশ নিলাম। চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জাতীয়

আন্তঃস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ১০০ মিটার, ২০০ মিটার স্পিন্টার, ৪০০ মিটার, ১০০ মিটার রিলে, হাই জাম্প এবং লং জাম্প এই ৬ টা ইভেন্টে ফাস্ট হলাম। তখন চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে অগণিত দর্শক করতালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারিনা।
চট্টগ্রামে স্টেডিয়ামে সাফল্যের পর আমাকে আর পিছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। স্পোর্টসে একের পর এক সাফল্য হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েছে। এছাড়াও আমার সাফল্যের পেছনে প্রিয় বান্ধবী এ্যাথলেট শাহনাজ পারভীনের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণাও আমাকে অনেক সাহস জুগিয়েছে।

এরপর বাংলাদেশ গেমসে খেললাম। পাওয়ার এ্যাথলেটিক্স মিট এ অংশ নিলাম। আস্তে আস্তে যখন আমি ইন্টার স্কুল শেষ করলাম। তখন পাবনার তৎকালীন ক্রীড়াবিদ ব্রজমোহন সাহা ন্যাশনাল স্কুল স্পোর্টসে আমার কয়েকটা ইভেন্টে ফার্স্ট হওয়া এবং আমার দৌঁড়ের স্টাইল দেখে আমাকেসহ বেশ কয়েকজনকে পাবনায় নিয়ে গেলেন। এরপর আমরা কাস্টমসে জয়েন্ট করলাম। কাস্টমসের তৎকালীন কোচ কালা দা আমাদের প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলেন। তার কাছে প্র্যাকটিস করে আমরা ন্যাশনাল স্পোর্টস এ অংশ নিলাম। ন্যাশনাল স্পোর্টসেও আমরা তৎকালীন ক্রীড়া প্রশিক্ষক শাহ আলম ভাই খালিদ ভাই, নাঈম ভাইয়ের কাছ থেকে ভালো ট্রেনিং পেলাম। এরপর সবাই আমরা ন্যাশনাল গেমসে ঢুকে গেলাম। ন্যাশনাল গেমসে ঢোকার পর তারা আমাদেরকে নিয়মিত প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলেন।
বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিয়ে আমি ফার্স্ট হলাম। এরপর পাওয়ার অ্যাথলেটিক্স, ন্যাশনাল গেমস, সাফ গেমস এবং সর্বশেষ ইন্টারন্যাশনাল গেমসে অংশগ্রহণ করি।

ইন্টারন্যাশনাল গেমসে অংশগ্রহণ করার পূর্বে আমরা সাফ গেমস করলাম। কক্সবাজারে আমাদেরকে এক বছর সাফ গেমসের প্র্যাকটিস করানো হলো। সেখানে আমি ১০০ মিটারের ফাইনালিস্ট হলাম। বাংলাদেশ সাফ গেমসে আমরা রিলে পদক পেলাম ২ টা ইভেন্টে। এরপর পর্যায়ক্রমে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, জার্মান, এবং চীনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইভেন্টে দেশের হয়ে অংশ নিয়েছি। চায়নাতে আমি বাংলাদেশ স্পোর্টস টিমের অফিসিয়াল হিসেবে গিয়েছি।

রেহেনা পারভীন বলেন, অফিসিয়ালি এখনও আমি খেলাধুলা ছাড়িনি। শুরু থেকে একটানা ‘৯৭, ‘৯৮ সাল পর্যন্ত আমি খেলতে থাকলাম। এরপর ‘৯৮ এ আমার বিয়ে হল এরপর আমার এপেন্ডিসাইড দুইবার অপারেশন হলো। বিয়ে এবং অপারেশনের পর আর মাঠে ফেরা হয়নি।
তবে স্পোর্টসম্যান হিসেবে মাঠে ফেরা না হলেও অফিশিয়াল হিসেবে আমি এখনও মাঠে আছি। অফিসিয়াল হিসাবে আমি জাতীয়ভাবে সাফ গেমসেও কাজ করেছি।

রেহানা পারভীন নিজে যেমন একজন সফল নারী জীবন সঙ্গিনী হিসেবেও পেয়েছেন একজন সফল পুরুষ যিনি এক সময়ের দেশসেরা এ্যাথলেট দেশের সুনাম এবং মর্যাদা বয়ে আনা আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ মোঃ মিলজার হোসেন। মিলজার হোসেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সম্পর্কে রেহেনা পারভীন বলেন, মাঠের বন্ধন থেকে ভালো লাগা। ভালোবাসি বা ভালো লাগে এভাবে কখনও তাঁকে বলা হয়নি। তবে মন থেকে তাকে ভালবাসতাম। মিলজারের ফ্যামিলিগতভাবে আমাদের পরিবারকে প্রস্তাব দেয়। তারপর পারিবারিকভাবে আমাদের বিয়ে হয়।
রেহেনা পারভীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন দক্ষ রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে সততা, দক্ষতা, সফলতা, কর্মনিষ্ঠ এবং সুনামের সাথে দায়িত্ব

পালন করছেন দীর্ঘদিন থেকে। বর্তমানে তিনি কুমিল্লা আখাউড়া স্থলবন্দরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

দেশসেরা এ্যাথলেট হয়েও তিনি কখনও লেখাপড়া থেকে বিচ্যুত হননি। রাজশাহী মহিলা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তি হন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইসলামের ইতিহাসে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
রেহেনা পারভীন ভালো কবিতা লেখেন, ভালো আবৃত্তি করতে পারেন। পারেন উপস্থাপনা করতে। ঝুম ঝুম প্রকাশনী থেকে তার কবিতার বই “ভুলভুলাইয়া” প্রকাশিত হয়। দেশকে নিয়ে তার লেখা “নেমোসিসিসির ঘরবাড়ি”।
তিনি দুই সন্তানের গর্বিত সফল মাতা। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করে একটি চ্যানেলে উপস্থাপনা করছেন। ছেলে চট্টগ্রাম বায়েজিদ ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে পড়াশুনা করছে। স্বামী এবং ১ ছেলে নিয়ে বসবাস করেন চট্টগ্রামে।
রেহেনা পারভীনের শ্বশুরবাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামে। তার ব্যক্তিগত আচার ব্যবহারে স্বামী, শশুর বাড়ির লোকজন, সন্তান এবং শ্বশুরবাড়ির এলাকার লোকজনের কাছে তিনি ব্যাপকভাবে সমাদ্রিত।
রেহেনা পারভীন বলেন, আমরা যত বেশি খেলোয়াড়দের জীবনী তুলে ধরতে পারব তত বেশি খেলায় উৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, আমি স্বপ্ন দেখি এ্যাথলেটিক্সের জন্য একটা প্রতিষ্ঠান হবে, যেখানে ছোট বড় সবাই যারা আসতে আগ্রহী তাদের সাথে সময় কাটাবো।

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!