টাকার মান আরও কমেছে। এক দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে ৫০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে মঙ্গলবার এক ডলারের জন্য ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে; সোমবার লেগেছিল ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা। এই দরে বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এখন টাকা-ডলারের বিনিময় হার ঠিক হয়ে থাকে। আজ (মঙ্গলবার) ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে। দাম নির্ধারিত হয়েছে ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা। এটাই আজকের আন্তব্যাংক দর।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত এক মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৫ শতাংশ। আর এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
গত বছরের ৩০ জুন প্রতি ডলারের জন্য ৮৪ টাকা খরচ করতে হয়েছে। এক মাস আগে ৩০ মে লেগেছিল ৮৯ টাকা।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে আমেরিকান ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেলেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজি ভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, বাজারে তার চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করলেও ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় এনেছে ৯৬-৯৭ টাকায়, আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করেছে ৯৮ থেকে ৯৯ টাকা দামে। এর আগে মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। এখন ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রেই এ দাম ১০০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। আগে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলারের বিনিময় মূল্য উঠেছিল সর্বোচ্চ ৯৭ টাকা পর্যন্ত।
মঙ্গলবার খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলার ৯৭ টাকা ৯০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক মঙ্গলবার ৯৫ টাকা ৯৫ পয়সা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯৬ টাকায়। বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক ৯৭ টাকা দরে ডলার বিক্রি করেছে।
গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হচ্ছে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সব মিলিয়ে ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের মঙ্গলবার পর্যন্ত (১১ মাস ২৮ দিন, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত) ৭৫০ কোটি (৭.৫০ বিলিয়ন) ডলারের মত বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে গত ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
কিন্তু আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারে নিচে নামার শঙ্কা
আমদানি বাড়ায় বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। মঙ্গলবার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তথন রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গত বছরের ২৪ আগস্ট রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৭৪ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্সের ১১ মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই ১১ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১৯ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম।
তবে রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ উল্লম্ফন ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। এই ১১ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৭ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ বেশি।