সরকারের এবারের নির্বাচন ২০১৪ সালের নির্বাচনী মডেলের সম্প্রসারণ। এটা নির্বাচন নয়, ভোটের খেলা। এই নির্বাচন ঠেকাতে সবাই একসঙ্গে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই নির্বাচন। নির্বাচনের পর দেশ পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।
‘ভোট ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক সংলাপে দেশের বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ‘লেখক-শিল্পী-শিক্ষক-সাংবাদিক’ ব্যানারে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বেশির ভাগ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সরকার এবার যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা ২০১৪ সালের নির্বাচনী মডেলের সম্প্রসারণ বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সংলাপে তিনি বলেন, এবারের মডেলে যেটা সম্প্রসারণ করা হয়েছে সেটা হলো ভোটারদের উপস্থিত করতে হবে। আগে সরকারের বিবেচনায় এটা ছিল না। এবার ভোটারদের উপস্থিত করার জন্য স্বতন্ত্র, ডামি প্রার্থী দিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলা তৈরি করেছে। বলা হচ্ছে, যারা ভোট দিতে যাবে না, তারা হচ্ছে গণতন্ত্রবিরোধী, নির্বাচনবিরোধী।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার জনগণের ওপর ভর করছে না। সরকার ভর করছে বিজ্ঞাপনী সংস্থা, হামলা-মামলা, ধনিক গোষ্ঠী, সুবিধাভোগী আমলা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি এবং ভারত, চীন, রাশিয়ার মতো বিদেশি শক্তির ওপর।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট, ভোটের ট্রেন ট্র্যাকে (পথ) উঠে গেছে। আমাদের সরকার এতে চেপে বসেছে। কিন্তু এর গন্তব্য কোথায়? আমি তো মনে করি, আমরা একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কারণ হলো ভোটের খেলা হচ্ছে, কোনো নির্বাচন হচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, যে দলই ক্ষমতায় আসে, তারা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে। তবে আওয়ামী লীগের মতো এত নির্মম নির্যাতন, এত মরিয়াভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা অতীতে কেউ করেনি।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিএনপি আন্দোলন সফল করতে পারল না, এটা সত্যি। সবচেয়ে বড় সত্যি হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ভুয়া নির্বাচন ঠেকাতে পারছে না। সিপিবি পারছে না, বাসদ পারছে না, অধ্যাপক তানজিম পারছে না, আনু ভাই পারছেন না, আমি পারছি না। আমরা সবাই একসঙ্গে ব্যর্থ হচ্ছি। আর এই ভুয়া নির্বাচন যারা প্রতিষ্ঠা করছে, তারা জিতে যাচ্ছে।’
যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে বলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দিল্লিতে। এটা খুবই আশঙ্কাজনক। একটা রাষ্ট্র কোন অবস্থায় পৌঁছালে এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের সার্বভৌমত্বকেও বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।’
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর দেশে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করেন অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘দেশের ভেতরে ও বাইরের দুষ্ট শক্তি বিবেচনায় আমাদের সংকটের গভীরতা অনেক বেশি।’
সরকার পরিকল্পনা করে ট্রেনে আগুন দিয়ে তার দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে ‘তামাশার’ নির্বাচন করতে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।
নারীনেত্রী শিরীন হক বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমাদের অসহায়ত্ব আরও বাড়বে।’
ভোটের মধ্য দিয়ে জনগণের রায় প্রতিফলিত হচ্ছে না এবং এই ভোট তার মর্যাদা হারিয়েছে বলে মনে করেন সমকাল-এর উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান।
লেখক ও সংগঠক বাকি বিল্লাহর সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার আলী আর রাজী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার, নারীনেত্রী সীমা দত্ত, বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সহসভাপতি শামসুজ্জামান হীরা, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ কাইয়ুম, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ প্রমুখ।