করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। আট মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে খুলবে, তা কেউ জানে না। কারণ, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
বিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করছে, বেশির ভাগ সে সুবিধার বাইরে। অন্যদিকে খুলনার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী না থাকায় অনলাইন ক্লাস থেকে দূরে সরে আছে শিক্ষার্থীরা। সরকার টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস সম্প্রচার করছে, সেখানেও উপস্থিতি ভালো নয়। সব মিলিয়ে পড়াশোনা ও পরীক্ষা ছাড়াই চলতি শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এর চেয়েও ভয়ের বিষয় হলো, শিক্ষার্থীদের একাংশ পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়তে পারে!
সংগত কারণে সরকার আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পথেই হাঁটছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে আরেক দফায় ছুটি বাড়ানো হয়েছে। গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। সবমিলে নয় মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে, তবে উপকূলের শিক্ষার্থীরা-এ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে অভিযোগ। তাঁদের অভিযোগ গতিশীল মোবাইল টাওয়ার না থাকা ও প্রত্যন্ত গ্রামের অসচ্ছল পরিবার হওয়ায় এই পদ্ধতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে।
শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক চেয়ে অনলাইনভিত্তিক ‘দাকোপে গতিশীল মোবাইল টাওয়ার চাই’ নামে প্লাটফর্ম গঠন করেছেন উপকূলের শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাঁরা নিজেদের সমস্যা উল্লেখ করে গতিসম্পন্ন মোবাইল নেটওয়ার্ক চেয়ে নানান ধরণের মন্তব্য পোষ্ট করছেন।
ওই গ্রুপের একজন শিক্ষার্থী সৌরভ বিশ্বাস। বাড়ি উপকূলীয় দাকোপ উপজেলার কামারখোলা ইউনিয়নের শ্রীনগর গ্রামে। তিনি চায়না জিংগাজ্ঞানসাং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে চীনা থেকে জানুয়ারিতে গ্রামে চলে আসেন। মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যার কথা তুলে ধরে সৌরভ বিশ্বাস খুলনা গেজেটকে বলেন, প্রতিদিন ক্লাস চলছে অনলাইনে, তবে দেশে এসে বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি। ক্লাস করার সময় ল্যাপটপে ঠিকমত নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। বিকল্প কোনো ধরণের সুবিধা না থাকায় মোবাইলডেটা ব্যবহারই একমাত্র পন্থা। তিনি বলেন, ক্লাস শুরু হলে ল্যাপটপ ও মোবাইল ডিভাইস নিয়ে রাস্তার পাশে বা উঁচু কোনো জায়গা খুজে বসে পড়াশোনা করতে হয়।
সুতারখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাজিরা খাতুন জানান, মুঠোফোন হাতেধরে বসে থাকতে হয়। সঠিকভাবে কোথাও মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ফলে ক্লাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে অনেক সময় বাদ পড়ে যাচ্ছি। দুভোর্গে পড়তে হয় সব সময়।
উপকূলীয় বাজুয়া গ্রামের সরোজিৎ মণ্ডল নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ব্যবসায়িক কাজে অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে হয়। কিন্তু এ অঞ্চলে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা খুবই নাজুক বললেই চলে। মোবাইলের মাধ্যমে কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বিরক্ত হতে হয়।
চুনকুড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাধন শিক্ষক স্বপন কুমার রায় খুলনা গেজেটকে বলেন, নিজের বাড়ি হরিণটানা গ্রাম থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ দূরে বাজুয়াতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পাঠদান করাতে হয়। অনেক সময় অনলাইনে শিক্ষাভিত্তিক আলোচনা থাকে। কিন্তু নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে বেশির ভাগ সময় বিষয়ভিত্তিক আলোচনা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মহামারী করোনাকালে শিক্ষার্থীরা যাতে না ঝরে পড়ে, সেক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা খুবই কার্যকরি। তবে অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণে গতিশীল মোবাইল টাওয়ারস্থাপন করা জরুরি ছিল।
জানতে চাইলে গ্রুপটির ফোকাল পার্সন অসীম ঘরামী খুলনা গেজেটকে বলেন, আমরা মূলত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করি। তারই অংশ হিসেবে করোনাকালীনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও শিক্ষাকার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক।
তিনি আরও বলেন, উপকূলজুড়ে গতিশীল মোবাইল টাওয়ার না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে নানান ধরণের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এজন্য প্রথমে আমরা আলোচনা করে অনলাইনভিত্তিক একটি প্লাটফর্ম গঠন করেছি। সেখানে আমাদের দাবি প্রযুক্তির ব্যবহার করে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার আগে প্রযুক্তিব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে উপকূলের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির মাধ্যমে সকল কাজে অংশ নিতে পারবেন।
অনলাইনে পাঠদানে বৈষম্যও আছে বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শহরের সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা এমনিতেই পড়াশোনায় এগিয়ে থাকে। করোনা পরিস্থিতিতে তারা ক্লাস ও পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অনলাইনে। শহর ও গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। সরকার গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করছে। কিন্তু টেলিভিশনের ক্লাস খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না।
শিক্ষাবিদদের ধারণা, উপকূলীয় এলাকাগুলোর জন্য রয়েছে বেসরকারি মোবাইল টাওয়ার। কিন্তু সেগুলি পর্যাপ্ত গতিসম্পন্ন নয়। টাওয়ারগুলো গতিশীল করতে পারলে করোনাকালে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
খুলনা গেজেট / এ হোসেন