খুলনা, বাংলাদেশ | ৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ১০ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৮৮৬

উন্নয়নের উত্থান-পতনের শিকার খুলনা

অ্যাডভোকেট মোঃ বাবুল হাওলাদার

দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বন্দর ও শিল্পনগরী হিসেবে খ্যাত খুলনা। যদিও ২০২০ সালের ২ জুলাই খুলনার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের শেষ পেরেক ঠোকার পর খুলনা নামমাত্রই শিল্পনগরী। অনেক প্রতিকুলতার মাঝেও খুলনাসহ এ অঞ্চলের মানুষ স্বপ্নে বুক বেঁধেছিলেন পদ্মা সেতুর দিকে তাঁকিয়ে। মনে করা হচ্ছিল, পদ্মা সেতুকে ধরে খুলনা মহানগরীকে কেন্দ্র করে উন্নয়ন এবং অর্থনীতির একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটবে। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর এক বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এটাকে ধরে এখনও পর্যন্ত এ অঞ্চলে চোখে পড়ার মতো কোনো উন্নয়ন কর্মকা- ঘটেনি বা শুরু হয়নি। কারণ হিসেবে পদ্মা সেতুকে ধরে শুধুমাত্র খুলনা অঞ্চলই নয়, জাতীয় অর্থনীতিতে একটা ব্যাপক ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকারের যে মহাপরিকল্পনা করা উচিত ছিল, তা অবর্তমান।

শিল্প নগরীখ্যাত খুলনায় ১৯৯৩ সালে খুলনা টেক্সটাইলস্ মিলটি বন্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধের যে অশুভ সূচনা হয়েছিল, তার কিছুটা হলেও পূরণ হতে পারতো বেসরকারি উদ্যোগে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু এখানে জ্বালানি সংকটের কারণে তা গড়ে উঠছে না। প্রতিযোগিতামূলক দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েল, বিদ্যুৎ কিংবা প্রচলিত অন্য জ্বালানি দ্বারা উৎপাদন হবে অলাভজনক।

এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ। ২০০৬ সালে খুলনায় পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহের জন্য ৫৩০ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের অনেকটা কাজ শেষ হওয়ার পর খুলনায় আনা ৮১২ কিলোমিটার পাইপ সরিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়। এক পর্যায়ে প্রকল্প প্রত্যাহার করে এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা নাকের ডগা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। সুতরাং নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।

আজকের দুনিয়ায় বিমান বন্দর একটি শহর বা অঞ্চলের সার্বিক বিবেচনায় গুরুত্বের মাপকাঠি। ২০১৫ সালে ৫৪৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে ৫৩৬ একর কৃষি জমি এবং আবহমানকাল ধরে বসবাস করে আসা মানুষের বাস্তুভিটা অধিগ্রহণ করে তথা বিশাল অঙ্কের রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করে একটি খোঁড়া যুক্তিতে তা প্রত্যাহার করা হলো। অথচ দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সময়ে এবং আরামদায়ক যাতায়াতের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পর্যটন, মোংলা বন্দরের জন্য এটি অপরিহার্য।

খুলনায় এ সময়কালে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নির্মাণ ও সংস্কার, ড্রেন নির্মাণ ইত্যাদি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ক্ষেত্র বিশেষে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা ইত্যাদি কারণে প্রকল্প-ব্যয় বৃদ্ধি একটি বড় সংকট। সঙ্গত কারণেই কাজের মান এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনে খুলনা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনায় জলবায়ু পরির্তনের বিষয়টি মারাত্মকভাবে উপেক্ষিত।

জলাবদ্ধতা খুলনা মহানগরীর একটি অন্যতম প্রধান স্থায়ী সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তা কার্যত জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নগরীর ১০টি প্রাকৃতিক খাল পুনরুদ্ধারের উদ্যোগের ফাইল ডীপ ফ্রিজে। এ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত নগরায়ন, কেসিসি-কেডিএ সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের সমন্বয়হীনতা প্রধান সমস্যা।

মশা এবং মৌসুম ভিত্তিক মশাবাহিত রোগ এখন খুলনার আরেকটি স্থায়ী সমস্যা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ অনেকটাই উদাসীন। যেটুকুও উদ্যোগ আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। নদীবেষ্টিত খুলনা নগরীর নদ-নদীগুলো দখল-দূষণের শিকার হয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। রূপসা ব্রিজ (খানজাহান আলী সেতু) নির্মাণের পর রূপসা-ভৈরব নাব্যতা হারাচ্ছে। শোলমারী নদী মৃতপ্রায়। ময়ুর নদ রীতিমত স্থায়ী ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এগুলো পুনরুদ্ধার ও রক্ষার জন্য ড্রেজিং ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, অবকাঠামো নির্মাণ ও উজানের নদ-নদীতে বাধা প্রদান ইত্যাদি কারণে সুন্দরবন ঝুঁকির মধ্যে। সাথে রয়েছে অবৈধ কাঠ পাচার, পশু শিকার, বিষ দিয়ে মাছ শিকার প্রভৃতি।

মাদকের থাবায় খুলনা অনেকটা ক্ষতবিক্ষত, কিশোর গ্যাং এর উত্থান চরম পর্যায়ে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় যার প্রসার ঘটছে। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের প্রয়োগ। সর্বোপরি উন্নয়ন বঞ্চিত, উন্নয়নের উত্থান-পতনের শিকার খুলনার সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজন একটি টেকসই পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈষম্য দুর করার দাবি আদায়ে একটি গণজাগরণ।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, সদস্য সচিব, খুলনা নাগরিক সমাজ।

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!