খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ পৌষ, ১৪৩১ | ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেটকারে বাসের ধাক্কা, নিহত ৫, আহত ১০
  মাদারীপুরের কালকিনিতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলছে, ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে যাত্রার ধারাবাহিকতায় ৫০ বছর পার করলো কুয়েট

একরামুল হোসেন লিপু

প্রথমে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এরপর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি), সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৫০ বছর পার করলো খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ৩ জুন তিনটি বিভাগে ৯ জন শিক্ষক এবং ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন ছিলেন ছাত্রী। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমের যাত্রার পিছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ নির্দেশনা ছিলো বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়।

দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আয়োজন করে নানা অনুষ্ঠানমালা। আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন, প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রীতি সমাবেশ, কেক কাটা অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য র্যালী আয়োজন করা হয়।

বর্তমানে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং দেশে দক্ষ ও মেধাবী প্রকৌশলীদের অভাব পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এছাড়াও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা বিজ্ঞান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কুয়েট গ্রাজুয়েটদের শক্তিশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি দেশের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে হিসেবে প্রতিষ্ঠার অনুমোদন লাভ করে। এরপর অবকাঠামো তৈরীর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন স্থবির হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটিতে শত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও অবকাঠামো তৈরীর কাজ সন্তোষজনকভাবে চলতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ নির্দেশে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের ৩ জুন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তৎকালীন কলেজটির শিক্ষা কার্যক্রমের নীতিমালা নির্ধারিত হতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক। এছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনার ভার ছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে। স্থাপনা ও রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব ছিল গণপূর্ত অধিদপ্তরের। শিক্ষক নিয়োগ হতো সরকারি কর্ম কমিশনের মাধ্যমে।

এভাবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকার পর ১৯৮৬ সালের ১ জুলাই সরকার দেশের ৪ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে একসাথে স্বায়ত্তশাসিত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করে। যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি) খুলনার। তবে এটিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উন্নীত করা হলেও সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কারণে প্রশাসনিক আর্থিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে সিদ্ধান্তহীনতা ও জটিলতা তৈরী হয়।

অতঃপর দেড় যুগেরও বেশি সময় পর ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর সরকার প্রকৌশল ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনগ্রসরমান বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে উচ্চশিক্ষা গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানচর্চার সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দেশের ৪ টি বিআইটিকে একযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করে। খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৩ যুগ পর “খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়” হিসেবে নব উদ্যাম ও উৎসাহে যাত্রা শুরু করে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খ্যাতনামা এবং একমাত্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এটি। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর খুলনা নগরীর কেন্দ্রস্থল থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে খুলনা যশোর মহাসড়কের ফুলবাড়িগেটের পার্শ্ববর্তী আধুনিকতার ছোঁয়ায় নির্মিত স্থাপত্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত নৈসর্গিক শ্যামল-ছায়ায় ঘেরা সবুজের সমারোহে কুয়েটের অবস্থান। ১১৭ দশমিক ৩০২ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিস্তৃতি।

১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম ৩ টি বিভাগে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ৩টি অনুষদে ২০ টি বিভাগ ও ৩ টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। অনুষদ ৩ টি হলোঃ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে রয়েছে আটটি বিভাগ। বিভাগগুলি হলোঃ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, আরবান এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগ, বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, আর্কিটেকচার বিভাগ, গণিত বিভাগ, বিজ্ঞান বিভাগ, রসায়ন বিভাগ ও মানবিক বিভাগ। ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে রয়েছে ৫ টি বিভাগঃ ইলেকট্রিক্যাল ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে রয়েছে ৭ টি বিভাগঃ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, এনার্জি সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। তিনটি ইনস্টিটিউট হলোঃ ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজী (আইআইসিটি), ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট (আইডিএম) ইনস্টিটিউট অব এনভারমেন্ট এন্ড পাওয়ার টেকনোলজি (আইইপিটি)। বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের পর স্নাতকত্তোর পর্যায়ে গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইতোমধ্যে গ্রাজুয়েটদের ডিগ্রী প্রদানের জন্য ২০০৬, ২০১২ ও ২০১৮ সালে যথাক্রমে প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সমাবর্তনে ৮২২ জন স্নাতক, ২৫ জন স্নাতকোত্তর ও ১ জনকে পিএইচডি ডিগ্রী, দ্বিতীয় সমাবর্তনে ২ হাজার ৪৪১ জনকে স্নাতক, ১০৮ জনকে স্নাতকোত্তর ও ৬ জনকে পিইচডি ডিগ্রী ও তৃতীয় সমাবর্তনে ২ হাজার ৭৯৫ জনকে স্নাতক, ২২১ জনকে স্নাতকোত্তর ও ৮ জনকে পিএইচডি ডিগ্রী প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ৭ টি হল। এরমধ্যে ৬টি ছাত্রহল বাকী ১টি ছাত্রীহল।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অধ্যায়নরত ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ৭ হাজার ৮৭৬ জন। শিক্ষক রয়েছেন ৪৩০ জন। এর মধ্যে রয়েছেন খন্ডকালীন/ চুক্তিভিত্তিক / এডহক শিক্ষক, পিএইচডি/ সমমান ডিগ্রী শিক্ষক, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক, টিচিং এসিস্ট্যান্ট। কর্মকর্তা রয়েছেন ২৩৪ জন, ৩৯৯ জন কর্মচারী। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী রয়েছে ১টি এছাড়াও বিভাগিয়ারী লাইব্রেরী রয়েছে ১৮টি।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রূপান্তরের পর কুয়েটের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত হন প্রফেসর ড. এহসানুল হক। এরপর পর্যায়ক্রমে ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর ড. মো. নওশের আলী মোড়ল, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর, প্রফেসর ড. কাজী সাজ্জাদ হোসেন। ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় প্রফেসর ড. মিহির রঞ্জন হালদারকে এবং একই বছর ২১ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পান প্রফেসর ড. সোবহান মিয়া।

উত্তরোত্তর যুগোপযোগী নতুন নতুন বিভাগ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যাবৃদ্ধি, শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নয়ন, গবেষণা কার্যক্রমের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে যথাযথ ভূমিকা রাখা, এইসব কিছুই হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ণয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এ প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য ও গৌরব অক্ষুন্ন রেখে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ উন্নত সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । আর এই প্রচেষ্টার নেতৃত্বে রয়েছেন বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মিহির রঞ্জন হালদার এবং প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. সোবহান মিয়া।

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!