অনলাইনে প্রচারিত নাটক, সিনেমা ও টেলিফিল্মে আপত্তিকর কনটেন্ট (বিষয়বস্তু) দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ বন্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। দেশীয় সরকারি ও বেসরকারি বিনোদনভিত্তিক অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আসতে হবে। একই সঙ্গে ফেসবুক, ইউটিউব ও নেটফ্লিক্সের মতো বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন নিয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নির্ভর করবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র পাওয়া যাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূল প্রতিবেদনের ওপর। এসব বিধান রেখে ‘ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্টভিত্তিক পরিষেবা প্রদান এবং পরিচালনা নীতিমালা-২০২১’-এর খসড়া প্রস্তুত করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। খসড়াটি সম্প্রতি উচ্চ আদালতে জমা পড়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
নীতিমালার খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, বেসরকারি ও বিদেশি অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলোকে বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে নিবন্ধন নিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রতি অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের টাকা নিবন্ধন ফি গুনতে হবে। এতে একদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিপুল রাজস্ব জমা হবে, অন্যদিকে দেশের আইনকানুন ও কৃষ্টিকালচারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নাটক-সিনেমা নিয়ন্ত্রণের চাবিও থাকবে রাষ্ট্রের হাতে।
প্রচলিত নিয়মে দেশে প্রচারিত সিনেমাগুলো সেন্সর বোর্ডের মাধ্যমে দেখভাল করা হয়। কিন্তু নতুন হওয়া অনলাইন প্ল্যাটফরমের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ না থাকায় সম্প্রতি কয়েকটি সিনেমার কনটেন্ট নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হওয়া আলোচনা-সমালোচনার পর সরকার ওটিটি নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ওটিটি খসড়ার ‘উদ্দেশ্য’তে বলা হয়েছে, সৃজনশীলতা লালন, সৃজনশীল শিল্পকর্ম তৈরিতে সহযোগিতা এবং চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাসহ বাকস্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার জন্য সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘এই নীতিমালার অধীনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ব্যতীত ইন্টারনেট বা সমমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া কোনো বিদেশি বা দেশি প্রতিষ্ঠান ওটিটি ফ্ল্যাটফরম ব্যবহার করিয়া কোনো প্রকার কনটেন্ট, বিজ্ঞাপন সম্প্রচার-প্রদর্শন করিতে পারিবে না।’ নিষিদ্ধ কনটেন্ট প্রচারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে বলা হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পরিপন্থি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী তথ্য প্রচলিত আইনের পরিপন্থি, দেশীয় সংস্কৃতিবিরোধী, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্টকারী কোনো কনটেন্ট বা তথ্য উপকরণ প্রচার করা যাবে না।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় ওটিটি নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে। তবে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ গঠন হবে আইন প্রণয়নের পর। এর আগ পর্যন্ত সম্প্রচার নীতিমালা-২০১৪ অনুযায়ী তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় অধীনস্থ কোনো দপ্তর সংস্থা নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালন করবে। নীতিমালার খসড়ায় দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। প্রথমে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঁচ হাজার টাকার অফেরতযোগ্য ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডার জমা দিয়ে নির্ধারিত আবেদনপত্র নিতে হবে। এরপর বাংলাদেশি আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ফেরতযোগ্য আর্নেস্ট মানি হিসাবে ৫ লাখ টাকা এবং বিদেশি আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ২৫ লাখ টাকার ব্যাংক ড্রাফট/পে-অর্ডার আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে। তবে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে টাকা লাগবে না, শুধু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন দেখাতে হবে।
ওটিটি প্ল্যাটফরম পরিচালনার জন্য যে-ই আবেদন করুক, তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে সংবাদ ও টকশো প্রচার না করার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে কী কী ধরনের কনটেন্ট প্রচার হবে, সেগুলোর ধরন উল্লেখ করতে হবে। ওটিটি প্ল্যাটফরম সেবার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আবেদনের সঙ্গে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যের নাগরিকত্ব ও বয়স প্রমাণের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) কপি ও পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। বাংলাদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ছাড়পত্রের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতিবাচক রিপোর্ট লাগবে। অন্যথায় নিবন্ধনের জন্য বিবেচিত হবে না। অন্যদিকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ছাড়পত্রের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুকূল প্রতিবেদন লাগবে।
জানা যায়, নিবন্ধনপত্র গ্রহণকালে নিবন্ধন ফি বাবদ এককালীন বাংলাদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৫-১০ লাখ টাকা এবং বিদেশি আবেদনকারী ব্যক্তিকে ২০-৩০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়া নীতিমালায়। একবার নিবন্ধনের মেয়াদ হতে পারে ১-৫ পাঁচ বছর। তবে প্রতি অর্থবছরে নিবন্ধনকৃতদের নতুন করে নিবন্ধন নিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানকে প্রতিবছর ৩ লাখ টাকা এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ওটিটি প্ল্যাটফরম পরিচালনকারী প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানি আইন ১৯৯৪ সালের অধীনে বাংলাদেশে নিবন্ধিত হতে হবে।
খসড়া নীতিমালায় নিষিদ্ধ তথ্য উপকরণ হিসাবে বেশকিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-ইচ্ছাকৃত বা বিদ্বেষপূর্ণ কারণে কোনো উপকরণ দ্বারা জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অসম্মানিত করা যাবে না। শিশুর অংশগ্রহণে যৌনাচার বা যৌনাচার উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোনো উপকরণ তৈরি বা সম্প্রচার করা যাবে না। জাতি, ধর্ম বা কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সৃষ্টি করতে পারে-এই ধরনের কোনো উপকরণ তৈরি বা সম্প্রচার, রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন বা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো উপকরণ তৈরি বা সম্প্রচার এবং সংজ্ঞায়িত কনটেন্ট ব্যতীত কোনো ধরনের সংবাদ বা টকশো সম্প্রচার করা যাবে না। অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর এমন কনটেন্ট তৈরি বা সম্প্রচার বা প্রদর্শন করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
নীতিমালার এসব বিধিবিধান লঙ্ঘন করলে ওটিটি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ অনুযায়ী সেগুলো অপসারণ করতে হবে। না করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। কোনো ওটিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্য কোনা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ থাকলে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮ ধারা প্রয়োগ রাখার প্রস্তাবও রয়েছে নীতমালায়। বহুল বিতর্কিত এই আইনের ৮ ধারায় অনলাইন প্ল্যাটফরমের কনটেন্ট দ্রুত ব্লক করার সুযোগ রয়েছে।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, যৌথভাবে ওটিটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়া যাবে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান এককভাবে ওটিটি প্ল্যাটফরম প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারবে। তবে ফৌজদারি অপরাধ বা নৈতিক স্খলনজনিত কারণে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একক বা যৌথভাবে ওটিটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার অযোগ্য হবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা বাংলাদেশের অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর, ভ্যাট, লোন বা বিলখেলাপি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একক বা যৌথভাবে ওটিটি প্ল্যাটফরমের প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা করার যোগ্য হবেন না।
খুলনা গেজেট/ এস আই