খুলনা, বাংলাদেশ | ২ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৭ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  প্রীতি ম্যাচ : মালদ্বীপকে ২-১ গোলে হারাল বাংলাদেশ, সিরিজ শেষ হলো ১-১ সামতায়
  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ৮ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৯৯৪
  আগামীর বাংলাদেশ হবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার : ড. ইউনূস
  জুলাই-আগস্টে নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশে সময় লাগবে : উপদেষ্টা আসিফ

আয়নাঘরে ৯৪ দিন যেভাবে ছিলেন সেনা সদস্য মুকুল

গেজেট ডেস্ক

উত্তর-দক্ষিণে ছয় কদম। আর পূর্ব-পশ্চিমে চার কদম। এই হলো একটি কক্ষের আকার। ছাদ অনেক উঁচুতে। সেখানে সারাক্ষণ জ্বলে থাকে একটি বাতি। একটি ছোট খাটে বিছানা পাতা। পাশেই প্রস্রাব করার জন্য প্লাস্টিকের দুটি পাত্র রাখা। দেয়ালে দেয়ালে খোদাই করে নানা লেখা। কেউ লিখেছে পরিবারের ফোন নম্বর। খোঁজ জানানোর আকুতি। কেউ দাগ দিয়ে দিয়ে হিসাব করেছে বন্দিদশার দিনপঞ্জি।

এমন একটি ঘরেই ৯৪ দিন কাটানোর কথা জানিয়েছেন সাবেক সেনাসদস্য মো. মুকুল হোসেন। তিনি বলেছেন, কেন তাঁকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, কেন রাখা হয়েছিল অমন ঘরে, তা আজও তিনি জানেন না। সরকার পরিবর্তনের পর ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে তিনি এসেছেন সংবাদ মাধ্যমে।

২০০৩ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর করপোরাল পদে থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নেন মুকুল। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন আশুলিয়ায়। ভারতে বেড়াতে যাওয়ার ভিসা নিয়ে পরামর্শ করতে ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কলাবাগানে যান এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধু আশিস বিশ্বাসের ওই বাসা মূলত ছাত্রদের মেস। রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার দিকে চার থেকে পাঁচজন জন লোক এসে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয় মুকুলকে। হাতকড়া লাগিয়ে, মাথায় কালো কাপড় মুড়িয়ে, চোখ বেঁধে ছয়তলা থেকে নিচে নামানো হয় তাঁকে। এরপর একটি মাইক্রোবাসে তুলে বেদম মারধর করা হয়। মাথায়, মুখে ও চোখে ঘুষি মারতে থাকে অনবরত। গাড়িটি চলতে শুরু করার ৩০ থেকে ৪০ মিনিট পর থামে। গাড়ি থেকে নামিয়ে তিন থেকে পাঁচ কদম পার করে একটি কক্ষের মধ্যে নিয়ে বসানো হয় মুকুলকে।

মুকুলের বর্ণনায়, কক্ষটিতে অ্যারোসল ও এয়ারফ্রেশনারের গন্ধ ছিল। চোখ শক্ত করে বাঁধা। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আসেন। কী করেন, কয়টা মোবাইল, মোবাইলে কার ছবি, ভাই-বোন কী করে, মানিব্যাগে ব্যাংকের তিনটা কার্ড (ডেবিট) কেন, কোন ব্যাংক হিসাবে কত টাকা, এমন নানা প্রশ্ন করতে থাকেন ওই কর্মকর্তা। প্রশ্নের মধ্যেই লোহা–জাতীয় শক্ত কিছু দিয়ে দুই পায়ের ঊরুর ওপর ক্রমাগত পেটাতে করতে থাকেন একজন। মুকুল বলেছেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, কোনো মিথ্যা বলেননি। প্রায় ৩০ মিনিট পর থামে সেই নির্যাতন ও জিজ্ঞাসাবাদ।

‘বাইরে লোকজনের চলাফেরা দেখা যেত, কারও চেহারা দেখা যেত না’

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুজন দুই পাশ থেকে ধরে আরেকটি কক্ষে নিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেন। সব পোশাক খুলে নিয়ে একটি লুঙ্গি ও লাল রঙের সোয়েটার পরতে দেওয়া হয়। নিজে নিজে পোশাক পরার মতো অবস্থা ছিল না। কক্ষটিতে একটি চৌকি (খাট), বালিশ, বিছানার চাদর ও দুটি কম্বল। পূর্ব-পশ্চিম কোনায় প্রস্রাবের দুটি পাত্র। তার ওপরের দিকে একটি ভেন্টিলেশন ফ্যান। বিকট শব্দে সারাক্ষণ চালু থাকত এটি। রুমের মাঝ বরাবর ওপরের ছাদে একটি এনার্জি বাল্ব ২৪ ঘণ্টা জ্বলত। কক্ষটির ভেতরে এক কোনায় ছিল একটি সিসিটিভি ক্যামেরা।

কক্ষটির দুটি দরজা; একটি লোহার ও অন্যটি কাঠের। কাঠের দরজার ওপরের দিকে গোল করে বড় ছিদ্র করা ছিল, যা একটি কাঠ দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। ইচ্ছা হলে কাঠ সরিয়ে কক্ষের ভেতরের অবস্থা দেখত বাইরে থেকে। লোহার দরজা থাকত সব সময় তালাবন্ধ। বাইরে লোকজনের চলাফেরা দেখা যেত। তবে কারও চেহারা দেখা যেত না, সব সময় মুখোশ পরে থাকতেন তাঁরা। ফজর, জোহর, আসর ও এশার নামাজের সময়; টয়লেট, অজু ও গোসলের জন্য চারবার বের করা হতো। এর বাইরে জরুরি টয়লেটে যেতে চাইলে লোহার দরজায় শব্দ করলে লোক এসে নিয়ে যেত। চোখ বেঁধে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে টয়লেটে নেওয়া হতো। টয়লেটে নিয়ে হাত ও চোখ খুলে দেওয়া হতো। দরজার নিচ দিয়ে তিন বেলা খাবার দিত। সকালে শক্ত রুটি আর সবজি। দুপুরে ও রাতে ভাত, ডাল মিশ্রিত সবজি, মাছ বা ডিম। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখে বিশেষ খাবার দেওয়া হতো।

মুকুল হোসেন বলেন, এক সারিতে আনুমানিক পাঁচটি কক্ষ ছিল। প্রতিটি কক্ষেই তাঁর মতো একজন করে গুম হওয়া মানুষ ছিলেন। মাঝেমধ্যে দরজায় শব্দ করে ডাকাডাকি করত, উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করত। খাবার খুবই জঘন্য ধরনের ছিল। শুরুতে খাওয়া যেত না। এক সপ্তাহ পর এতেই অভ্যস্ত হয়ে যান।

র‍্যাবে হস্তান্তর ও মাদকের মামলা

২০১৯ সালের ৮ মে ইফতারের পর মুকুলকে প্রথম দিন পরে আসা কাপড় ফেরত দিয়ে দ্রুত তৈরি হতে বলা হয়। চোখে তিন পরতের কাপড় বেঁধে বের করে নিয়ে মাইক্রোবাসে তোলা হয়। আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ মিনিট গাড়িটা চলার পর থামে। সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলার একটি কক্ষে নিয়ে হাতকড়া ও চোখ খুলে দেওয়া হয়। ওই কক্ষে হাতকড়া পরা আরও তিনটি ছেলে ছিল। দরজার কাছে রাখা স্ট্যান্ড ফ্যানে লেখা ছিল র‍্যাব-১ এমটি পুল। পরদিন জোহরের নামাজের আগে চোখ বেঁধে, হাতকড়া লাগিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিমানবন্দর–সংলগ্ন মনোলোভা কাবাবের সামনে। গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তা পার করে একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে লোকজনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর একটি মাইক্রো এসে দাঁড়ালে ধাক্কা দিয়ে ওই গাড়িতে তোলা হয়।

১০ মিনিট পর আবার র‍্যাব কার্যালয়ে আনা হয়। একটি টেবিলের ওপর ছোট ছোট প্যাকেটে ইয়াবা, পাশে মুকুলের দুটি মোবাইল ও পাসপোর্ট রেখে তাঁর ছবি তোলা হয়। ৯ মে রাত আনুমানিক ৯টার দিকে বিমানবন্দর থানায় হস্তান্তর করা হয় তাঁকে। ৭০০টি ইয়াবাসহ আটকের মামলা দেওয়া হয় তাঁর নামে। তিন দিনের রিমান্ডে এনে অত্যাচার চালানো হয় থানায়। এরপর কারাগারে গিয়ে জামিনে মুক্তি পান সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে।

গত ৯ এপ্রিল তাঁর মামলার শুনানি ছিল। আদালতে গিয়ে জানতে পারেন, মার্চে তাঁর মামলার রায় হয়ে গেছে; পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। এর পর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। দেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর তিনি এখন তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চাচ্ছেন।

মুকুল হোসেন বলেন, ‘মুরগির হাড় দিয়ে দেয়ালে দাগ কেটে দিন হিসাব করতাম। আগেও কেউ কেউ করে গেছে ওই কক্ষের দেয়ালে। ৯৪ দিনের প্রতিটি দিন কাঁদতাম, প্রার্থনা করতাম। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে পঙ্গু হয়ে গেছি।’

কথা বলতে বলতে কেঁদে দেন মুকল। তিনি আরও বলেন, ‘এখন নতুন সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চাই। আমার মামলা প্রত্যাহার করে আমাকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তারা। আমার মতো যাঁরা গুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সবার পাশে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে সরকার।’

 

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!