খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ পৌষ, ১৪৩১ | ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ময়মনসিংহে ট্রাক-অটোরিকশার সংঘর্ষে একই পরিবারের ৪ জন নিহত
  নিখোঁজের ৪২ ঘণ্টা পর কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী নদী থেকে দুই পর্যটকের মরদেহ উদ্ধার

আমার সাংবাদিকতার ৪৫ বছর, ইনকিলাবেই কাটলো ৩৫

মিজানুর রহমান তোতা

কখনো বিপুল প্রতিকুলতা, ঘাত-প্রতিঘাত ও গাঢ়ো কালো অন্ধকার। আবার কখনোবা ব্যাথা ও বেদনা জয় করে আলোর আকাঙ্খার মাঝে নিত্যনতুন স্বপ্ন দেখে এগিয়ে চলা। সুর্যোদয় আর সূর্যাস্ত অসংবাদিত সত্য। চলমান জীবনে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ থাকবে এটিই স্বাভাবিক। সব জানালা দরজা বন্ধ হয়ে আবার মুহূর্তে বাতাসের ঝাপটায় খুলে যায়। প্রতিটি জীবনের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে থাকে। কুসুমাস্তীর্ণ না হলেও মাঠ সাংবাদিকতায় আমার জীবন কাটলো একটানা ৪৫ বছর। এর মধ্যে একটানা ৩৫ বছরই কাটলো দেশ ও জনগণের মুখপাত্র দৈনিক ইনকিলাবে।

মূলতঃ ১৯৭৭ সাল থেকেই ছড়া, কবিতা, সংবাদ লেখালেখিতে প্রবেশ। ১৯৭৮ সালে দৈনিক গণকন্ঠের রিপোর্টার, সমাচারের স্টাফ রিপোর্টার, ১৯৭৯ সালে দৈনিক স্ফুলিঙ্গের স্টাফ রিপোর্টার, ১৯৮০ সালে পিআইবির লং কোর্সের প্রশিক্ষণ, তারপর দৈনিক স্ফুলিঙ্গের নিউজ এডিটর, দৈনিক ঠিকানায় নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আজাদের স্টাফ রিপোর্টার ও বিশেষ প্রতিনিধি. এর মাঝে সাপ্তাহিক ছুুটি, সাপ্তাহিক পূর্নিমায় খন্ডকালীন লেখালেখি, তারপর থেকেই দৈনিক ইনকিলাবে। অনেক সুযোগ হলেও ইনকিলাব ছাড়েনি।

মাঠ সাংবাদিকতায় কোথায় কীভাবে এবং কেন বাধা আসে, কতটা আনন্দ ও আশার স্বপ্নে ভাসে, বিভাজনের রেখায় মহান পেশায় বিঘ্নতা কোন পর্যায়ে পৌঁছে, জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি কতটা, কিভাবেই বা হয় বিবেক ক্ষতবিক্ষত, তা জীবনের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিক চালচিত্র তুলে ধরে ‘মাঠ সাংবাদিকতা’ নামে একটা গ্রন্থ প্রকাশ করেছি। এটি আমার জীবনের বড় অর্জন বলে মনে করি। বিশেষ করে একসময় সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে খ্যাত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঝুঁকির মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশী।

সাংবাদিকতা ছিল কঠিন। মাঝেমধ্যেই সাংবাদিকদের দিকে শ্যেন দৃষ্টি পড়ে রাজনৈতিক ক্যাডারদের। সন্ত্রাসী, অপরাধী, সমাজবিরোধী ও অস্ত্রবাজ চরমপন্থীরা ফণা তোলে। জটিল হওয়া রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি করা নেতাদের দাম্ভিক চেহারাও ফুটে ওঠে। কোনকিছুতেই অধৈর্য্য, বিরক্তি ও হতাশা বাসা বাধেনি। বরং এর মধ্যেই সাহস নিয়ে সামনে পা ফেলতে কোনরকম দ্বিধা বা কুন্ঠাবোধ করিনি। থাকিনি বিন্দুমাত্র পিছিয়ে। এতে নিত্যনতুন হরেকরকম অভিজ্ঞতার ঝোলা ভরে তোলার সুযোগ হয়েছে। ভাবনার মর্মস্থল হয়েছে সমৃদ্ধ। মাঠ সাংবাদিকতায় যেসব সমস্যা, বাঁধা, বিপদ আপদ, বঞ্চনা,স্বপ্ন, বাস্তবতা, হুমকি ধামকি, হয়রানী ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে তার চিত্র ফুটে উঠেছে ওই গ্রন্থে।

সমুদ্রের মতো দিকচিহ্নহীন বৈচিত্রে অনন্ত এক জীবন হচ্ছে সাংবাদিকতা। জীবন নামের যন্ত্রটি চলছে প্রায় ৬৫ বছর। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত। অনেকটা নেশার বশবর্তী হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত হওয়া। ক্ষণিকের জন্যও অন্য কোন পেশায় আত্মনিয়োগ করিনি। আমি জীবনটা দেখি একটা দিনের সমান। সূর্য এখন প্রায় ডুবুডুবু। কখন তলিয়ে যাবে সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আলামিন ভালো জানেন। সমাজ ও ইতিহাস জানার আগ্রহ সবার। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।

পেশার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সমাজের সব অত্যাচার, নির্যাতন, অনাচার, অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্দশা, সমস্যা, অসঙ্গতি, ব্যর্থতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, সুলভ উপায়ে স্বার্থসিদ্ধির নানা বিষয়ের বিরুদ্ধে কলম ধরতেই পেশাটি বেছে নিই। পেশাটি সত্যিকারার্থে স্বাধীন। কিন্তু নানা কারণে সব কথা প্রাণ খুলে লেখা যায় না, বলা যায় না। কোথায় যেন আটকে যায়। বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। লিখলেই ঘটে বিপত্তি।

আমার সাংবাদিকতা জীবনে যেমন রঙীন স্বপ্ন ভরপুর, তেমনি অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়েছি, হয়েছি বেদনায় নীল। অনেক সময় নির্যাতনের মাত্রা চরমে পৌঁছে শিউরে ওঠার মতো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন হয়ে গেছে তছনছ। ছোট বড় ভুমিকম্পও নেমে এসেছে মাঝেমধ্যে। আবার সিডর ও আইলায় বিধ্বস্ত সুন্দরবনের গাছপালার মতো জেগে উঠেছি। যুক্তিহীনতার ছড়াছড়ির মাঝে যুক্তির সন্ধান করতে পিছু হটিনি। পরিস্কার বিশ্বাস জন্মেছে সামাজিক দায়বোধ থেকে করা সৎ সাংবাদিকতায় অবশ্য সাময়িক আঘাত আসলেও পরাস্ত করতে পারে না।

যদিও শুধু পেশার কারণে ব্যক্তিগতগভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব থেকে সবসময় সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছে পেশা ছেড়ে দাও, এই পেশা মারাত্মক ঝুঁকিপুর্ণ। তারপরেও থেমে থাকিনি, থামেনি গতি। উপরন্তু ছুটোছুটির পেশায় আত্মনিয়োগ করে পৃথিবীর অপরূপ বর্ণচ্ছটায় হয়েছি মুগ্ধ, মন ভরে গেছে আনান্দে। ভুলে গেছি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো যন্ত্রণাদায়ক সব অত্যাচার নির্যাতন। দেখেছি হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাম্প ছড়িয়ে সত্যকে ঘায়েল করতে একই মিথ্যা নানারূপে। সম্পুর্ণ অকারণে নিদারুণভাবে আঘাত পেয়েছি। যাতে রাতের চেয়েও অন্ধকার নেমে আসে। অবশ্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও মানুষের গভীর ভালোবাসা, সাংবাদিকদের সহযোগিতা এবং করুণাময় আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রতিবারই চক্রান্ত ও ষঢ়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। ফিরে এসেছি মৃত্যুর দুয়ার থেকে।

আমার প্রথম গ্রন্থ ‘মাঠ সাংবাদিকতা’। প্রকাশ হয় ২০০৮ সালে একুশের বই মেলায়। গ্রন্থটিতে ঘোষণা ছিল পরবর্তী প্রকাশনা ‘ক্ষতবিক্ষত বিবেক’। সময় হয়ে ওঠেনি। নিত্যদিনের সংসার, ধর্ম-কর্ম, সাংবাদিকতার চাকরী ঠেকাতে যেখানে সেখানে ছুটে বেড়ানো, এমনকি অনলাইনে প্রতিমুহূর্তের রিপোর্টিং করতে গিয়ে ব্যস্ততায় গলদঘর্ম অবস্থা হয়। এরইমাঝে হয়ে যায় আমার ব্রেইন স্ট্রোক। বাঁচবো কি মরবো তা নিয়ে সবার টানাটানি। মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি, তিনি আমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রহমতে ব্রেইনে বড় ধরণের কোন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু বাম হাত ও পায়ের শক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলি। ২০১৫ সালে আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘ক্ষত বিক্ষত বিবেক’ প্রকাশ হয়। এরপর ২০২১ সালে প্রকাশ হয় কাব্যগ্রন্থ ‘দিবানিশি স্বপ্নের খেলা’। প্রস্ততি নিচ্ছি গল্প গ্রন্থের।

আজ ৪জুন দৈনিক ইনকিলাবের জন্মদিন। দীর্ঘ ৩৫টি বছর জীবন-যৌবন কাটালাম। সাংবাদিকতায় পেশায় যুক্ত হয়ে অনেক বন্ধু রাজধানীতে ফ্লাট প্লটের গাড়ি বাড়ির মালিক হয়েছে। আফসোস নেই। মাঠে চলাচল করে ইনশাআল্লাহ ভালো ভাবেই জীবন কাটালাম। পড়ন্ত বেলায় আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই।

আমি যশোর সংবাদপত্র জগতে বিচরণ করে অবিভক্ত যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, একবার প্রেসক্লাবের সেক্রেটারি ও তিনবার সভাপতি হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। ছোট্ট এই জীবরে আর বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই। একজন কবি সাংবাদিক হিসেবে আমার মনে হয় জীবনের অঙ্কে ¦ যোগবিয়োগের ফলাফল একেবারে শূন্য নয়। বড় দুঃখ আমার জীনসঙ্গীনি সাংবাদিক রেবা রহমানের অনুপস্থিতি। তার অকাল মৃত্যু জীবনটা অনেকটা এরোমেলো করে দিয়েছে। তবুও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া আদায় করি।

আমার ৩ ছেলে মেয়ের অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করিয়ে বিয়ে দিয়ে তারপর রেবা রহমান বিদায় নেয়। এখন আমি নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ ভালো দিন কাটাচ্ছি। আমি এখন আর কোন কোন ইউনিয়ন বা প্রেসক্লাব পলিটিক্সে নেই। কোন লোভ-লালসা এবং প্রত্যাশারও জন্ম নেয় না আমার বিন্দুমাত্র।

আমি নির্দ্দিধায় নির্বিঘ্নে স্বীকার করি আমি সমূদ্রের ব্যাঙ নই, কুঙোর। বড়ো মাপের সাংবাদিকও নই। আমার কবিতা ও লেখালেখিতে সমাজ রাষ্ট্রের জনগণের কোন উপকারে আসে কী আসে না, সেটি জানি না। রাজধানীতে থাকলে হয়তো বড়মাপের সাংবাদিক হতে পারতাম। ঢাকার পত্রিকার ডেস্কে কয়েকদফা সুযোগ হয়েছিল। গ্রহণ করিনি। মেধা যোগ্যতায় কুলায়নি এটি ও বলতে পারেন। তবে মফস্বলে থেকে একটু আধটু কবি ও সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত।

কলমজীবি হিসেবে পেশার প্রতি অন্ধত্বে অনবরত লিখেই যাচ্ছি-আজো লিখছি। আমার ভিন্ন কোন পেশা নেই। একদিনের জন্যও লেখালেখির বাইরে থাকিনি। এটি বড় বোকামি কী না জানি না। তবে শেষ বয়সে এখন আর ভিন্ন কোন চিন্তাভাবনা মাথায় ঢুকাতে চাই না। লেখালেখির মধ্যেই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই।

সবার দোয়া ও ভালোবাসা চাই। সবাই ভালো থাকবেন সবসময়। (ফেসবুক ওয়াল থেকে)

খুলনা গেজেট/ এস আই




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!