আজ বিশ্ব প্রবীণ দিবস। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি প্রতিবছর ১ অক্টোবর পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে এ দিবসটি পালন করা শুরু হয়। মূলত প্রবীণদের অবহেলা না করে তাদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টিই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য। এ বছর ৩৩তম প্রবীণ দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ”সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীণদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রæতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা’’।
জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুসারে, বাংলাদেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। সে হিসেবে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ বয়সে প্রবীণ। বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশের অধিক প্রবীণ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বেশি হচ্ছে। ১৯২১ সালে এ দেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল যেখানে ২০ বছর, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৩ বছর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯.২৮ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের তথ্যমতে, দেশে দেড় কোটির বেশি প্রবীণ আছেন। জনসংখ্যার বার্ধক্য আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থা বলা যায়।
বর্তমানে গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানে ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সেও অবসর প্রদান করতে হয়। নতুবা সক্ষম প্রবীণদের প্রতি সমাজের এটা হবে বৈষম্যমূলক আচরণ। প্রবীণ নাগরিকদের মর্যাদা, অগ্রাধিকারসহ সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সরকার নানা কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। এ সরকারের গৃহীত বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রশংসার যোগ্য। এছাড়া সম্প্রতি সরকারি চাকরিজীবীর বাইরে সর্বজনীন পেনশন ভাতা প্রবর্তন করেছে সরকার। বাংলাদেশে উন্নত দেশগুলোর মতো রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুরক্ষা, যাতায়াত ও চিকিৎসা সুবিধা, বৃদ্ধনিবাস ইত্যাদি এখনও গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে কিছু কাজ হয়েছে। তবে তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। এই অবস্থায় রাষ্ট্র তথা সরকারকে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আরও ভাবতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রবীণদের কল্যাণে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। দেশে উন্নত মানের বৃদ্ধনিবাসের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুস্থ ভাতাসহ সাশ্রয়ী মূল্যে চাল ও আনুষঙ্গিক কিছু কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। যা প্রবীণদের জন্য কল্যাণকর হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্যানুসারে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ হবে প্রবীণ। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা হবে দুই কোটি ৮০ লাখ এবং ২০৫০ সালে দাঁড়াবে প্রায় চার কোটি ৫০ লাখ। জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, আগামী দুই থেকে আড়াই দশকের মধ্যে বাংলাদেশ প্রবীণ প্রধান দেশে পরিণত হবে। বাংলাদেশ প্রবীণ প্রবণ সমাজে পদার্পণ করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রবীণ প্রধান সমাজ পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। দ্রæততম সময়ে এই পরিবর্তন ঘটতে চলেছে, বিশ্বে এমন সব দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। তখন দেশে শিশুদের চেয়ে প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। দেশের আইনে সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক বয়স্ক নাগরিকের মর্যাদাসহ বেঁচে থাকার অধিকার আছে। বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতাকে সন্তানের কাছ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ২০১৩ সালে ‘পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন’ প্রণয়ন করে সরকার। পিতা-মাতার ভরন-পোষণ না করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। তবে পরিবার বা সমাজে এই নীতিমালা এখনো তেমন কার্যকর হয়নি। এ নীতিমালার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময় ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করা এবং জাতীয় নীতিমালায় প্রবীণ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে-বিদেশে সর্বত্র আজ বার্ধক্যে উপনীত মানুষ চরম অসহায়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রবীণরা দুর্ব্যবহার, অবহেলা, নির্যাতন এবং শোষণের সম্মুখীন হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের সমাজে অধিকাংশ প্রবীণই অবহেলিত ও নির্যাতিত। পরিবার ও সমাজে তারা অপাঙেক্তয়। অথচ দেশের উন্নয়ন তথা আজকের সমাজ ও সভ্যতার মূল কারিগর তারাই। একসময় যারা তাদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন, তারা প্রবীণ বয়সে অবহেলিত হবেন, বঞ্চনা, নির্যাতনের শিকার। তাই প্রবীণ ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
দেশে দেশে বাড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর হার। আর আজকের প্রবীণদের হাত ধরেই বর্তমান সময় আমরা পেয়েছি। তাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বর্তমান সমাজ সবসময় ঋণী। বর্তমানের তরুণ যুবকরাও ভবিষ্যতে প্রবীণ হবে। তাই বর্তমানে প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারলে ভবিষ্যতের প্রবীণরাও উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা আশা করতে পারবে। প্রবীণদের জীবনের মানোন্নয়নে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে আমাদের দেশেও বাস্তবায়ন করা হোক- আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে এটাই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা।
লেখক : সমাজ গবেষক, শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসুদন কলেজ, যশোর-৭৪০০, বাংলাদেশ।
খুলনা গেজেট/এইচ