ইরান পরিচিতি:
ইরান বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার একটি, যার ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন পার্সিয়ান সভ্যতা ইরানের ভিত্তি স্থাপন করে, যা প্রথমে আচেমেনিদ সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০) দ্বারা গঠিত হয়। পরবর্তীতে সাসানীয় সাম্রাজ্য ও ইসলামী বিজয়ের মাধ্যমে ইরানে ইসলাম প্রচার পায়। ৭ম শতকে আরবদের বিজয়ের পর ইরান মুসলিম বিশ্বে অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে তারা পারস্য সংস্কৃতি ও ভাষার নিজস্বতা ধরে রাখে। আধুনিক ইরান রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯শ শতক ও ২০শ শতকের প্রথম দিকে, যখন পাশা শাসকরা আধুনিকীকরণের চেষ্টা করে। ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিপ্লব ইরানকে একটি নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচিতি দেয়, যার ভিত্তি ইসলামিক আইন ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব
১৯৩৫ সালের আগে আন্তর্জাতিকভাবে ইরান পরিচিত ছিল ‘পারস্য’ নামে। যদিও ‘ইরান’ শব্দটির ব্যবহার স্থানীয়ভাবে বহু আগে থেকেই হয়ে আসছিল। এই ইরান বা পারস্যকে দু’শো বছরের অধিক সময় ধরে শাসন করেছিলো সাফাভিদ রাজবংশ। এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন ইসমাইল প্রথম। তিনি দ্বাদশী শিয়া মতবাদকে ইরানের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। সাফাভিদের পরে ইরানকে শাসন করে কাজার রাজবংশ। কাজার রাজবংশ ১৭৮৫ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ইরানকে শাসন করেছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর এই কাজার রাজবংশের আমলেই ইরান-সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে অল্পকিছু তেলের খনি আবিষ্কার হয়। তখন মধ্যপ্রাচ্যের এই তেলের খনিগুলো দখল করার জন্য ব্রিটিশ, ফ্রান্স, আমেরিকাসহ ইত্যাদি পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এমনকি তেলের বাজার দখলের জন্য ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করে ‘অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি’, যা পরবর্তীতে ‘ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম’ নাম ধারণ করে।
ইরান-পশ্চিমা শত্রুতা :
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে পশ্চিমাদের চোখে ইরান যেন ‘অবাধ্য রাষ্ট্র’। পারমাণবিক কর্মসূচি, ইসরায়েল বিরোধী অবস্থান, মধ্যপ্রাচ্যে তেহেরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সব মিলিয়ে ইরানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে সন্দেহ, শঙ্কা আর শত্রুতার দেওয়াল। কিন্তু এই শত্রুতার বীজ কি সত্যিই বিপ্লব পরবর্তী? নাকি তার অনেক আগেই বপন হয়েছিল শত্রুতার বীজ?
একসময় যুক্তরাষ্ট্র ছিলো ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু বর্তমানে এই যুক্তরাষ্ট্রই ইরানের সবচেয়ে বড় শত্রু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমারা কীভাবে এবং কেন ইরানের শত্রুতে পরিণত হলো? কীভাবে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইরানের আবির্ভাব হলো?
ইতিহাস কী বলে?
পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে ইরানের যে শক্তিশালী অবস্থান তার পেছনে রয়েছে বিশাল এক ইতিহাস। দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর ধরে চলামান রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে আধুনিক ইরানের আবির্ভাব হয়েছিল যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তার নাম ‘ইরানিয়ান রেভ্যুলেশন’। এই ইসলামিক বিপ্লব পরিবর্তন করে দিয়েছিল ইরানের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কাঠামো। ইরানের এই ইসলামিক বিপ্লবকে ফরাসি ও বলশেভিক বিপ্লেবের পর ইতিহাসের তৃতীয় মহান বিপ্লব হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সমর্থনে কাজার রাজবংশের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান হয়। ক্ষমতায় বসানো হয় ব্রিটিশ অনুগত রেজা শাহ পাহলভীকে। এই রেজা শাহ দেশের নাম পারস্য থেকে ইরানে পরিবর্তন করেন। রেজা শাহ পশ্চিমাদের অনুকরণে ইরানকে ধর্মীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি সেকুলার বা ধর্মনিরেপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চালান। কিন্তু অধিক পরিমাণে পশ্চিমাপন্থি এবং সেকুলার মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ইরানের জনগণ এবং প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতারা রেজা শাহের প্রতি অসন্তুষ্ট হতে থাকে। ফলে ১৬ বছরের ক্ষমতার অবসান ঘটিয়ে ১৯৪১ সালে রেজা শাহ পদত্যাগ করেন। এরপর ক্ষমতায় বসে তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা পাহলভী। তার আমলে ইরানে প্রচুর তেলের খনি আবিষ্কার হয় আর তিনি সমস্ত মূল্যবান সম্পদ মার্কিন ও ব্রিটিশদের মালিকানায় রেখে বিলাসবহুল জীবন-যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এমন পরিস্থিতিতে ইরানে এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব ঘটে তার নাম মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি ছিলেন কিছুটা কমিউনিস্ট ভাবধারার। মোসাদ্দেক তখন মোহাম্মদ রেজার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন ব্রিটিশ কোম্পানি থেকে তেলের মালিকানা মুক্ত করে তেল সম্পদ জাতীয়করণ করবেন। তার এই জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ইরানি জনগণকে খুব দ্রুত আকর্ষণ করে। ফলে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে মোসাদ্দেক। ১৯৫১ সালের ২৮ এপ্রিল মোসাদ্দেক ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন।
মোসাদ্দেকের জয়ের ফলে হুমকির মুখে পড়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। ইরান থেকে তাদের স্বল্প দামে তেল আমদানি প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রমে পৌঁছায়। মোসাদ্দেকের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইরানের তেল সম্পদ জাতীয়করণ করলে তেল রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে প্রচুর অর্থ গুনতে হয়। মোসাদ্দেকের উত্থানের কারণে এই দুটি রাষ্ট্রের জন্য ইরানের তেল হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই মোসাদ্দেকের এ জয় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি তৎকালীন ক্ষমতাশালী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্রুম্যান।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা SIS ইরানে একটি সেনা বিপ্লবের নীল নকশা তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন এজক্স’ (Operation Ajax)। এই অপারেশন এজক্সকে আবার TPAJAX Project বা Operation Boot ও বলা হয়। CIA ও SIS লন্ডনে বসে অপারেশন ‘এজক্স’ এর নীল নকশাটি তৈরি করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে কয়েকদিনের মধ্যেই ইরানে মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে এক সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে ১৯৫৩ সালে ঘটে যাওয়া এই অভ্যুত্থানটি ‘1953 Iranian coup d’état’ নামে পরিচিত। জাহেদী সেনা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন এবং মোসাদ্দেককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে শাহ তাকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন। তখনো মূল শাসন ক্ষমতা ইরানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর হাতেই।
১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের CIA এর সহযোগিতায় মোহাম্মদ রেজা ইরানে ‘সাভাক’ (SAVAK) নামে গোপন পুলিশ ফোর্স গঠন করে। এই সাভাকের কাজ ছিলো বিরুদ্ধ মত দমন করা। যারাই রাজবংশের বিরুদ্ধে কিছু বলতো তাদেরকে এই পুলিশ ফোর্স গোপনে আটক করে জেলে বন্দি করত।
১৯৭০-এর দশকে মোহাম্মদ রেজা শাহ পশ্চিমা সংস্কৃতির চরম অনুকরণ শুরু করলে দেশব্যাপী এক গভীর অসন্তোষ তৈরি হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা ঘোষণা করেন (Rastakhiz Party), যা ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আরও সঙ্কুচিত করে। এই সময়ে ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি রাজনৈতিক ইসলামের ব্যাখ্যার মাধ্যমে শাহবিরোধী আন্দোলনের নেতা হয়ে ওঠেন। তাকে ১৯৬৪ সালে নির্বাসনে পাঠানো হয়, কিন্তু তিনি নির্বাসন থেকেই বিপ্লবের ডাক দিতে থাকেন।
অবশেষে ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে মোহাম্মদ রেজা দেশ ছেড়ে পালান। ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে আসেন খোমেইনি এবং ১১ ফ্রেবুয়ারী ইসলামী বিপ্লবের নেতা হিসেবে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। এরপর ৩০ মার্চ অনুষ্ঠিত গণভোটে ৯৮.২ শতাংশ ভোটে জনগণ ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেয়। ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বিপ্লবের কিছুদিন পর, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯, তেহরানে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস দখল করে নেয় ছাত্ররা। তারা ৫২ জন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন ধরে জিম্মি করে রাখে। যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনার পর ইরানকে “সন্ত্রাসবাদ সমর্থক রাষ্ট্র” হিসেবে চিহ্নিত করে। শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি শীতল বৈরিতা।
পশ্চিমা হস্তক্ষেপ :
১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধ হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে ইরাককে সমর্থন দেয়, যা ইরানের দৃষ্টিতে ছিল সরাসরি পশ্চিমা হস্তক্ষেপ। পরে যুক্তরাষ্ট্র একাধিকবার ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক জোট গঠন করে। ২০১৫ সালে ছয় জাতির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) স্বাক্ষর হলেও, ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি বাতিল করে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি করে। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করা হয়। ইরান এই ঘটনার বদলা হিসেবে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়। ২০২৩-২৪ সালের হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধেও ইরানকে অভিযুক্ত করে পশ্চিমারা। তাদের দাবি, ইরান হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিয়ে ‘সন্ত্রাসবাদ ছড়ায়’। অন্যদিকে ইরান বলে, তারা ‘প্রতিরোধ ফ্রন্ট’-এর পক্ষ এবং এটি পশ্চিমা দখলদারিত্ব ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই।
ইরান ও পশ্চিমাদের দ্বন্দ্ব কেবল তেল বা অস্ত্র ঘিরে নয়, এটি এক আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মপরিচয়ের লড়াই। একদিকে রয়েছে পশ্চিমা উদার গণতন্ত্র ও লিবারেল ভ্যালু, অন্যদিকে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো। ইরান নিজেকে ‘মুসলিম উম্মাহ’র পক্ষে নেতৃত্বদানকারী শক্তি হিসেবে দেখতে চায়, আর পশ্চিমা বিশ্ব তা দেখে একটি বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ হিসেবে।
ইরান-পশ্চিম সম্পর্কের এই দীর্ঘ ইতিহাস প্রমাণ করে যে, এই বৈরিতা হঠাৎ জন্ম নেয়নি। এটি শতাব্দী প্রাচীন ঔপনিবেশিক স্বার্থ, ধর্মীয় রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য ঘিরে গড়ে ওঠা দ্বন্দ্ব। প্রশ্ন হচ্ছে, এই আদর্শিক ও ভূরাজনৈতিক সংঘাত কখনও কি মীমাংসার পথে যাবে? নাকি আরও নতুন সংকট, নতুন জোট ও নতুন যুদ্ধ দিয়ে তা আরও জটিল হয়ে উঠবে?
আমেরিকা-ইসরাইল বন্ধুত্ব :
আমেরিকার সঙ্গে ইসরাইলের বন্ধুত্ব — একে শুধুমাত্র কূটনৈতিক সম্পর্ক বললে কম বলা হবে। এটি একটি গভীর ঐতিহাসিক, কৌশলগত এবং আদর্শিক সম্পর্ক, যার শিকড় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল এবং এরও আগে পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র এটিকে স্বীকৃতি দেয় — বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর একটি।প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান ব্যক্তিগতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করেন, যদিও পররাষ্ট্র দপ্তর কিছুটা দ্বিধায় ছিল।
এই সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র ছিল।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সোভিয়েত প্রভাব বেড়ে যাচ্ছিল (যেমন: মিশর, সিরিয়া)।
ইসরাইল ছিল পশ্চিমাপন্থী ও গণতান্ত্রিক— তাই যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে একটি বিশ্বস্ত মিত্র হিসেবে বিবেচনা করে।
১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল মিশর, জর্ডান ও সিরিয়াকে পরাজিত করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার হয়।
পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ইয়াম কিপুর যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে বিপুল পরিমাণ সামরিক সাহায্য দেয়।১৯৭৯ সালে মিশর- ইসরাইল শান্তি চুক্তি (Camp David Accord) তে মধ্যস্থতা করে যুক্তরাষ্ট্র।এর পর থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রায় ৩. ৮ মিলিয়ন ডলার সামরিক সাহায্য দিয়ে আসছে (Foreign Military Financing)।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালী ইহুদী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা রাজনীতি, মিডিয়া, ব্যবসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নেন।AIPAC( American Israel Public Affairs Committee) এর মতো লবিং গ্রুপগুলোর প্রভাব রয়েছে।ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অনেক মার্কিন খ্রিস্টান ইসরাইলকে বাইবেলের ভূমি হিসেবে দেখে সমর্থন করে (Evangelical Christiansইসরাইল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে সামরিক ঘাঁটি না রাখলেও তথ্য আদান-প্রদান, গোয়েন্দা সহযোগিতা ও অস্ত্র উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করে।যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নতুন অস্ত্র প্রথমে ইসরাইলে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার হয়।
৯/১১ জন সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে” ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠে।ইরান কে ঘিরে উদ্বেগ (নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম) যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।যদিও কিছু বিষয়ে দ্বিমত আছে (যেমন: ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রশ্নে), তবে সামগ্রিকভাবে সম্পর্ক দৃঢ়।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় ইসরাইল গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সহায়তা উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহযোগিতা রাজনৈতিক প্রভাব, মার্কিন রাজনীতিতে ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রভাব, ধর্মীয় সংস্কৃতির সংযোগ বাইবেলভিত্তিক সমর্থন, খ্রিস্টান ইভানজেলিকালদের ভূমিকা ভোট ব্যাংক রাজনীতি ও মার্কিন রাজনীতিকরা অবস্থান নেন ভোট ও তহবিলের জন্য এগিয়ে যান।
পরিশেষে:
ইরান ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং আমেরিকা-ইসরায়েল মিত্রতার গভীর শেকড় ইতিহাস, ভূরাজনীতি ও আদর্শিক অবস্থানে নিহিত। একদিকে ইরান নিজেকে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একত্র হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে চায়। এই দ্বন্দ্ব শুধু তেল, পারমাণবিক অস্ত্র বা কূটনীতি ঘিরে নয়—এটি একটি মূল্যবোধের সংঘর্ষ, যেখানে পশ্চিমা লিবারেল আদর্শের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো।
এই প্রেক্ষাপটে, ইরান-পশ্চিম সম্পর্ক এবং আমেরিকা-ইসরায়েল জোটকে বুঝতে হলে শুধু বর্তমান ঘটনাবলীর দিকে তাকানো যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন গভীর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করার। প্রশ্ন রয়ে যায়—এই সংঘর্ষের সমাপ্তি কি কখনো সম্ভব? নাকি বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এটি একটি স্থায়ী অক্ষরেখা হিসেবেই থেকে যাবে?
খুলনা গেজেট/এনএম