মুহাররম হিজরী বর্ষের প্রথম মাস এবং আরবী বার মাসের মধ্যে সম্মানিত চারটি মাসের একটি। সুরা তাওবাহ এর ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বার মাসের মধ্যে চারটি মাস কে সম্মানিত বলেছেন। তার মধ্যে মহররম অন্যতম। বিশেষ করে এই মাসের দশ তারিখ ইসলামী শরীয়তে একটি গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনটি ইসলমী ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। ‘আশুরা’ শব্দটি আরবি।
এর অর্থ, দশম। শব্দটি হিজরি বর্ষের ১০ তারিখকে বুঝায়। দিনটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এই দিনটি ইতিহাসের এক মহান ঘটনার স্বাক্ষী। আল্লাহ তায়ালা এই দিনে হযরত মুসা (আঃ) এবং তার অনুসারীদেরকে ফেরাউন ও তার সন্যদের হাত থেকে নাজাত দিয়েছেন এবং ফেরআউনকে তার সন্যসহ নদীতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন।(বুখারী-১৮৭৮)
এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার ব্যাপারে এটিই বিশুদ্ধ বর্ণনা। এছাড়া এই দিনের ব্যাপারে আরো কিছু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- ১০ মহররম পৃথিবী সৃষ্টি করা, এই দিনে কেয়ামত সংঘটিত হওয়া, হযরত আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামের সৃষ্টি, বেহেশতে প্রবেশ। জান্নাত থেকে বের হয়ে আদম-হাওয়া আরাফাতের ময়দানে একত্রিত হওয়া, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আগুন থেকে নাজাত, হযরত নুহ আলাইহিস সালামকে মহাপ্লাবন থেকে নিষ্কৃতি ও তাঁর পাপিষ্ঠ জাতিকে ধ্বংস, এই দিনেই অত্যাচারী শাসক নমরূদের ধ্বংস, হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে মুক্তি, হযরত ঈসা আ. কে আসমানে উঠিয়ে নেয়া, আদম আ. এর তাওবা কবুল হওয়া, ইউসুফ আ. এর কারাগার থেকে মুক্তি এবং আইউব আ. এর দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসা ইত্যাদি।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররম কারবালায় হজরত হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটে।
ইসলামের ইতিহাসে ফজিলতময় আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সর্বশেষ সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে ওঠে। আশুরা দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালায় শহীদ হওয়ার ঘটনায় আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা।
কারবালার শিক্ষা:
১.ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা:
সুতরাং, কারবালার ঘটনা কেবল একটি শোকাবহ ঘটনা নয়, বরং এটি মুসলিমদের জন্য এক আলোকবর্তিকা, যা তাদের সত্য ও ন্যায়ের পথে চলতে এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করে।
২.ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম:
কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার সঙ্গীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করেছেন এবং শাহাদাত বরণ করেছেন। এটি আমাদের শিখিয়েছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকতে হবে।
৩.ত্যাগের শিক্ষা:
কারবালার ঘটনা আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুসলিম উম্মাহকে এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন।
৪.অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ:
কারবালা আমাদের শিখিয়েছে, জালিম ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষের কর্তব্য।
৫.সংগ্রামী চেতনা:
কারবালা আমাদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করে, যা আমাদের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে উৎসাহিত করে। স্মরণ রাখতে হবে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের আগেই ইসলামী শরিয়ত পূর্ণতা লাভ করেছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শরিয়ত পূর্ণাঙ্গরূপেই সংরক্ষিত থাকবে। সুতরাং সে অনুযায়ী সবার আমল করা জরুরি। তাতে কোনো ধরনের সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ নেই।
অতএব রাসুলুল্লাহ (সা.)র ইন্তেকালের পর সংঘটিত কোনো বিপদ বা আনন্দের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো দিন বা কোনো মাসের নতুন কোনো মর্যাদা বা নতুন কোনো বিধান আবিষ্কার করা যাবে না। এমন করা হলে তা হবে পরিষ্কার বিদআত ও গোমরাহি।
বর্জনীয়:
১. তা’যিয়া বানানো অর্থাৎ,তাযিয়া বলতে মূলত ইমাম হোসেন (রা.)-এর সমাধির একটি প্রতিকৃতি বা প্রতীককে বোঝায়, যা মিছিলে বহন করা হয়। এবং এতে নানা রকমের পতাকা ও ব্যানার টাঙ্গিয়ে মিছিল করে, যা সম্পূর্ণ নাজায়িয ও হারাম। এছাড়াও আরো বহুবিধ কুপ্রথা ও গর্হিত কাজের সমষ্টি হচ্ছে এ তা’যিয়া। (ইমদাদুল ফাতাওয়াঃ ৫/২৯৪,৩৩৫, কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৩২, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৩)
২. ‘হায় হুসেন’, ‘হায় আলী’ ইত্যাদি বলে বলে বিলাপ ও মাতম করা এবং ছুরি মেরে নিজের বুক ও পিঠ থেকে রক্ত বের করা। এগুলো করনেওয়ালা, দর্শক ও শ্রোতা উভয়ের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (আবূ দাউদ, হাঃ নং ৩১২, ইবনে মাজাহঃ হাঃ নং ১৫৮৪)
৩. হযরত হুসাইন রাযি. ও তাঁর স্বজনদের উদ্দেশ্যে ঈছালে সাওয়াবের জন্য বিশেষ করে এই দিনে খিচুড়ি পাকিয়ে তা আত্মীয়-স্বজন ও গরীব মিসকীনকে খাওয়ানো ও বিলানো। একে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ যেহেতু নানাবিধ কু-প্রথায় জড়িয়ে পড়েছে তাই তাও নিষিদ্ধ ও না-জায়িয।
(কিফায়াতুল মুফতীঃ ৯/৪০)
৪. আশুরার দিনে শোক পালন করা, চাই তা যে কোন সূরতেই হোক। কারণ শরীয়ত শুধুমাত্র স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রীর জন্য ৪ মাস ১০ দিন আর বিধবা গর্ভবতীর জন্য সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুতে সর্বোচ্চ ৩ দিন শোক পালনের অনুমতি দিয়েছে। এই সময়ের পর শোক পালন করা জায়িয নেই। আর উল্লেখিত শোক পালন এগুলোর কোনটার মধ্যে পড়ে না। (বুখারীঃ হাঃ নং ৫৩৩৪
৫. শোক প্রকাশ করার জন্য কালো ও সবুজ রঙের বিশেষ পোশাক পরিধান করা। (ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়াঃ ২/৩৪৪)
কারবালার ঘটনা থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ ও বর্জনীয় বিষয়গুলোকে পরিহার করার তৌফিক দান করুন।
লেখক: বিশিষ্ট মোফাচ্ছেরে কোরআন, খুলনা।
খুলনা গেজেট/এনএম