ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বিধিনিষেধ না মেনে কেনাকাটা ও গ্রামের বাড়ি যাওয়ার ঘটনায় ঈদের পর আবারও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা জানিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই আশঙ্কা সত্যি করে ঈদের পর দেশে করোনা সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারতফেরত যাত্রীরা। তাদের অনেকে করোনা পজিটিভ হয়েছেন; কয়েকজনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর প্রভাবে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে।
শুক্রবার (২৮ মে) স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সংক্রমণের হার টেনে ধরতে সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হলে সাতক্ষীরা, রাজশাহী ও খুলনাতেও লকডাউনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এই প্রসঙ্গে অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার খুরশীদ আলম বলেন, ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও তিনটি জেলা আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। সংক্রমণ বাড়লেই সেগুলোতে লকডাউনের চিন্তাভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা যখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা লকডাউন ঘোষণা করি, তখন ওই জেলায় সংক্রমণের হার ছিল ৪০ শতাংশের ওপরে। আর অন্য জেলাগুলোতে এখনো সংক্রমণ অনেক নিচে। তবে যদি বাড়তে থাকে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়া হবে।
১৭ থেকে ২৩ মে — এই এক সপ্তাহে বাংলাদেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, আগের সপ্তাহের (১০ থেকে ১৬ মে) তুলনায় ২২টি জেলায় নতুন রোগী বৃদ্ধির হার শতভাগ বা তার বেশি ছিল। এগুলোর মধ্যে ১৫টি জেলাই সীমান্তবর্তী। এই জেলাগুলোর মধ্যে ৯টির প্রতিটিতে এক সপ্তাহে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পঞ্চাশের নিচে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদে অনেক মানুষ ঢাকা থেকে নিজ নিজ গ্রামে গিয়েছিলেন। লোকসমাগমও আগের চেয়ে বেশি হয়েছে। ঈদ উপলক্ষে মার্কেটেও ভিড় ছিল। সংক্রমণে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার এটি একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। তবে এর সঙ্গে করোনার ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) কোনো যুক্ততা আছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অধিদফতরের করোনা বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঈদের পর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ তুলনামূলক বেশি। আক্রান্তদের কারো কারো সম্প্রতি ভারত সফরের ইতিহাস আছে। বৃহস্পতিবার (২৭ মে) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন কার্যালয় এক দিনেই ভারত থেকে আসা ১৩ জনের করোনা শনাক্ত হওয়ার তথ্য দিয়েছে। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে আছেন। এ নিয়ে আখাউড়া সীমান্ত হয়ে আসা ২৩ জনের করোনা শনাক্ত হলো।
এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলোজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বর্ডারের কয়েকটি জেলায় আবারও সংক্রমণ বাড়ছে। সরকার ইতোমধ্যেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য বিশেষ লকডাউন ঘোষণা করেছে। এখন অন্য জেলাগুলোতে দিন দিন শনাক্তের হার যেভাবে বাড়ছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা ৩৭ জেলায় আবার লকডাউন ঘোষণা করা যেতে পারে।
কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঈদে কয়েক লাখ মানুষ ঢাকা থেকে নিজ নিজ গ্রামে গিয়েছিল ঈদ করতে। ফলে গ্রামগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লোকসমাগম হয়েছিল। যা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার অন্যতম একটি কারণ। আবার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ সংক্রমণ নিয়ে দেশে ঢুকেছে। সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হলেও সেটা করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে যেভাবে মানুষ কেনাকাটা ও গ্রামের বাড়িতে যাওয়া শুরু করেছিল, সংক্রমণ তো বাড়বেই। আমরা আগেই বলেছিলাম ঈদের ১০ থেকে ১৪ দিন পরেই এর প্রভাব দেখা যাবে। এখন তা-ই দেখা যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেও সংক্রমণ বাড়ছে, এক্ষেত্রে করোনার ভারতীয় ধরনও কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে করণীয় একটাই, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। যেখানে রোগী বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে, সেখানে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে গত মার্চের মতো অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ করেই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই করোনা পজিটিভ ছিলেন। তাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। অন্যান্য সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় করোনা সংক্রমণের হার বেশি, সেসব জায়গাতেও আমরা এরই মধ্যে লকডাউন দিয়েছি। বাকি যেসব ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, আমরা সেসব নিচ্ছি।
করোনা সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংক্রমণের হার যদি বাড়ে, তাহলে অবশ্যই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে ১০১ থেকে ৫০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে এমন জেলাগুলোর মধ্যে সীমান্তবর্তী জেলা সাতটি। এগুলো হলো- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেট। এছাড়া এই তালিকায় আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, নোয়াখালী ও গাজীপুর।
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক সপ্তাহে (১৭–২৩ মে) ১৭৯ জন রোগী শনাক্ত হয়। আগের সপ্তাহে শনাক্ত হয়েছিল ৭৩ জন। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনা সংক্রমণের হার ৬৩ শতাংশ এবং পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহীতে এই হার ৪১ শতাংশে উঠেছে। এছাড়াও ৪০ শতাংশের ওপরে সংক্রমণ রয়েছে খুলনায়। এমন পরিস্থিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় গত সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য বিশেষ লকডাউন চলছে।
১৮ মে থেকে সংক্রমণ বাড়ছে সীমান্তবর্তী আরেক জেলা কুষ্টিয়ায়। এখন সেখানে রোগী শনাক্তের হার ১৪–১৬ শতাংশ। এরমধ্যে ভারত থেকে আসা ১৪৫ জন এখন কুষ্টিয়ায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন।
সাতক্ষীরায় ঈদের আগে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৩ শতাংশ। গত সোমবার থেকে শনাক্তের হার ৪০ শতাংশের ওপরে।
এর আগে গত ১৮ মে দেশের করোনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক জানিয়ে ৩৭টি জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ৪০ শতাংশের ওপরে সংক্রমণ রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও খুলনায়। ২০ থেকে ২৯ শতাংশ সংক্রমণ রয়েছে সিলেট, ঝালকাঠি, রাজশাহী, নাটোর ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও ফরিদপুরে।
এছাড়া ১০ থেকে ১৯ শতাংশ সংক্রমণের হার রয়েছে দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ফেনী, রংপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, বরিশাল, সাতক্ষীরা, গাজীপুর বগুড়া, গোপালগঞ্জ, যশোর, মাদারীপুর, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, মাগুরা, নওগাঁ, কক্সবাজার, ভোলা, নড়াইল, লক্ষ্মীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা এবং টাঙ্গাইলে।
খুলনা গেজেট/ এস আই